অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯১ হাজার পাঁচ কোটি টাকা-লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি প্রায় আট হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বছরের শুরুতেই এমন ধীরগতি ভবিষ্যতের আর্থিক চাপে ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাজস্ব সংগ্রহের তিনটি প্রধান খাত-আয়কর, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) মধ্যে একমাত্র ভ্যাট খাত লক্ষ্য ছাড়িয়েছে। ভ্যাটে ৭১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় হলেও আয়কর ও আমদানি শুল্কে ঘাটতি মোট রাজস্ব কাঠামোকে দুর্বল করে দিয়েছে। তিন মাসে আয়কর খাতে ঘাটতি হয়েছে ছয় হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, আর শুল্কে তিন হাজার ৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুতেই রাজস্ব প্রবাহে একটি কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এনবিআরের ব্যাখ্যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাভাবই রাজস্ব আদায়ে মন্থরতা এনেছে। সত্যিই, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি, এবং ডলারের উচ্চমূল্য ব্যবসায়িক গতি কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এটি কি কেবল সাময়িক পরিস্থিতি, নাকি রাজস্ব ব্যবস্থার গভীরে প্রোথিত অদক্ষতার প্রতিফলন? প্রতি মাসেই লক্ষ্যমাত্রার নিচে আদায় প্রমাণ করে যে এটি কেবল বাজারগত নয়, বরং প্রশাসনিক দুর্বলতা ও কর পরিপালনের সংস্কৃতির অভাবও দায়ী। কর আদায়ে দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি এবং কর ফাঁকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। আয়কর খাতের ঘাটতি এই দুর্বলতার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে, সরকার আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং কর জিডিপি অনুপাত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই অবস্থায় রাজস্ব ঘাটতি শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক আর্থিক আস্থার ক্ষেত্রেও চাপ তৈরি করতে পারে। বাজেট বাস্তবায়নের অর্ধেকের বেশি নির্ভর করছে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ওপর। এখন প্রয়োজন, রাজস্ব সংগ্রহের প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসা। কেবল লক্ষ্য বাড়িয়ে নয়, কর পরিপালনের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। স্বচ্ছ ও সহজ করনীতি, ব্যবসাবান্ধব কর প্রশাসন এবং ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার প্রসার রাজস্ব প্রবাহকে টেকসই করতে পারে। অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধার না হলে রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে, আর সেই চাপ পড়বে উন্নয়ন ব্যয় ও সামাজিক খাতে। রাজস্ব সংগ্রহ কেবল হিসাবের বিষয় নয়-এটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মাপকাঠি। তাই সময় এসেছে রাজস্ব ব্যবস্থাকে প্রকৃত সংস্কারের পথে নিয়ে যাওয়ার।