সরাইলে ভূমি দখলে জালিয়াতি বেড়েই চলছে

এফএনএস (মাহবুব খান বাবুল; সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : | প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:৫৭ পিএম
সরাইলে ভূমি দখলে জালিয়াতি বেড়েই চলছে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ভূমি খেকু চক্রের একের পর এক তথ্য গোপন ও জালিয়াতিতে অতিষ্ঠ অনেক পরিবার। সর্বশেষ শিকার ইসলামাবাদ গ্রামের ৬ কৃষক পরিবার। এসব কাজে তথ্য গোপন, ভুয়া দলিল, জাল জন্ম নিবন্ধন সনদ, বাতিলকৃত বিএস ও খাজনার রশিদ কৌশলে ব্যবহার করছে চক্রটি। জাল ও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বায়না দলিল সৃজনে চক্রটিকে সহায়তা করছে স্থানীয় কতিপয় দলিল লেখক। বিনিময়ে খাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। ধরা পড়ে একাধিক লেখক কারাবরণ  করেছেন। মাসের পর মাস অনেকের দলিল নিবন্ধন কাজ বন্ধ রেখেছেন কর্তৃপক্ষ। তারপরও থামছে না তাদের অপকর্ম। ওদিকে নিজেদের সম্পত্তি রক্ষা করতে ভুমি, সাবরেজিষ্ট্রি অফিস ও আদালতে দৌঁড়ঝাঁপ করে পেরেশান হচ্ছেন অনেক দরিদ্র অসহায় পরিবার। অর্থনৈতিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তারা। এসব কাজে সংশ্লিষ্ট ভূমি ও সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের যোগসাজসের কথা বলেছেন অনেক ভুক্তভোগি। 

সরেজমিন অনুসন্ধান, ভুক্তভোগি ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সরাইল সদরসহ আশপাশের ইউনিয়ন গুলোতে ভুয়া কাগজপত্র আর জালিয়াতির মাধ্যমে জায়গা জমি দখলের ঘটনা বেড়েই চলেছে। কৌশলে সঠিক তথ্য গোপন করে তৈরী করছে দলিল। সেই দলিল দিয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসের সহায়তায় সারছেন নাম খারিজ। ধরা পড়ে খারিজ বাতিল হলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে একাধিক মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দিয়ে হয়রানি করছে একাধিক চক্র। এতে বাড়ছে হানাহানি, দাঙ্গা ফ্যাসাদ ও মামলা। নাম খারিজের আবেদনকারী রাকিবুল ইসলাম ঠাকুর। এ বছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর শুনানিতে গ্রহীতা রাকিবুলের দেয়া ২০০২ সালের ১৮ ই জুন রেজিষ্ট্রি করা ২৪০৬ নম্বর দলিলে দাতা সামছুল আলম ঠাকুর, পিতা- তাহের উদ্দিন ঠাকুর। জেলা সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসে যাচাই করে উল্লেখিত তথ্য পাওয়া যায়। একই দলিল সরাইল সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যাচাই করলে ভিন্ন দাতা মিলে। এখানে দাতা শফিকুল হোসেন সহ ৬-৭ জনের নাম পাওয়া যায়। পরে খারিজ আবেদনে দেয়া দলিলটি জাল তা স্বীকার করেন রাকিবুল। অপরাধ স্বীকার করায় ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন বেগম রাকিবুল ইসলাম ঠাকুরকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেছেন। এ ঘটনায় সরাইল সদর ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান বাদী হয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর সরাইল থানায় মামলা করেছেন। মামলায় লেখককেও আসামী করা হয়েছে। নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ইসলামাবাদ গ্রামের কালু মিয়া একই গ্রামের আরজু মিয়ার কাছ থেকে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ৩৩৮২ নম্বর ও ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ২১৮৩ নম্বর দলিল মূলে বিভিন্ন দাগের মোট ০.৫২০ একর জায়গা ক্রয় করেন। নাম খারিজ করেননি কালু মিয়া। বর্তমানে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’জনই মৃত। কালু মিয়ার ছেলে আলফাজ আলী, মুখলেচ আলী, মুর্তুজ আলী, আছমত আলী, সাবেদ আলী ও হযরত আলী। ওই জায়গায় বাড়িঘর ও কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। প্রায় ৩৫ বছর পর ওই জায়গার উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে প্রয়াত আরজু মিয়ার ছেলে হারূ মিয়ার। সম্প্রতি সরাইল সদরের কুট্রাপাড়া গ্রামের সৈয়দ সারোয়ার মিয়া নামের ব্যক্তিকে জায়গাটি দলিল করে দেন। ৩৫ বছর আগের সকল তথ্য গোপন করে সারোয়ার জায়গাটির নাম খারিজ করেন। বিষয়টি জেনে সংশ্লিষ্ট সহকারি কমিশনার (ভূমি) বরাবর আবেদন করেন আফজল গংরা। শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তথ্য গোপন করে সারোয়ারের ১০৩১/২৩-২৪ নম্বর  নামজারি মোকদ্দমা মূলে সৃজিত ১০৭৩ খতিয়ান (বিএস) বাতিল ও নামঞ্জুর করেন তৎকালীন সহকারি কমিশনার (ভূমি) নাছরিন সুলতানা। আবেদনের প্রেক্ষিতে কালু মিয়ার উত্তরাধিকারীদের নামে নাম খারিজ হয়। ব্যর্থ ও ক্ষুদ্ধ হয়ে হারূ সারোয়ার গংরা আলফাজ আলী গংদের বিরূদ্ধে একাধিক মিথ্যা বানোয়াট মামলা ও উচ্চ আদালতে রীটের মাধ্যমে হয়রানির অভিযোগ ওঠেছে। কোন কিছুই ধোঁপে ঠিকেনি সারোয়ার গংদের। তাদের দলিল ও বিএস খতিয়ান ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি এসি ল্যান্ড সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসকে পত্র দ্বারা (স্বারক নং-৭১৫, তাং-৩০.১০.২০২৩ খ্রি:) অবহিত করেন। ভবিষ্যতে ওই ভুয়া কাগজপত্র দ্বারা জায়গা ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্ট্রি না করারও অনুরোধ করা হয়। তারপরও গত ২ সেপ্টেম্বর তারিখে সৈয়দ সারোয়ার গংরা মো. আশিকুর রহমানের (আল-আমিন) নামে ভুয়া ও বাতিলকৃত বিএস খতিয়ান দ্বারা সরাইল সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উক্ত জায়গা বায়নাপত্র দলিল রেজিস্ট্রি করে দেন। এ বিষয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর হযরত আলী সরাইল উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রার, ইউএনও ও এসিল্যান্ড বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন হযরত আলী। অভিযোগ তদন্তাধীন আছে।

হয়রত আলী বলেন, সারোয়ার গংদের ভুয়া দলিল ও বিএস এসিল্যান্ড মহোদয় যাচাই করে বাতিল করেছেন। আমরা পিতার ক্রয়কৃত জায়গায় গত ৩৫ বছর ধরে বসবাস করছি। নিয়মিত খাজনা আদায় করছি। অযথা মিথ্যা মামলা দিয়ে সারোয়ার আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। তার যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। ভুমি খেকু সারোয়ারের হাত থেকে বাঁচতে আমরা প্রশাসন ও দেশবাসীর সহায়তা চাই। সৈয়দ সারোয়ার আলম বলেন, তৎকালীন এসিল্যান্ড নাসরিন সুলতানা আমার কাগজ বাতিল করেছে। মন্ত্রণালয় থেকে আমার কাগজ ঠিক আছে।   

শাহবাজপুর মৌজায় প্রয়াত আব্দুল বারিকের কন্যা মোসাম্মৎ খালেদা খাতুনের এস.এ খতিয়ান নং-১৮৩০ ও বি.এস দাগ নং-৫৪৮২ থেকে ১.৫০ শতক বাড়ির জায়গা সীমানা সংলগ্ন বাসিন্দা মো. মনিজুর রহমানের স্ত্রী মোছাম্মৎ আকলিমা আক্তারের কাছে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। যাহার সাফ কাবলা দলিল নং-২৯১১ ও তারিখ-২৯.০৪.২০২৫ খ্রি.। খাজনা আদায়ের জন্য ২০২৪-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে নামজারী মোকদ্দমার মাধ্যমে মিউটেশন করেন। এরপর ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে আসছেন। সম্প্রতি খালেদা খাতুনের বোন রূনা আলম নামজারী ছাড়া ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের হেবা বিষয়ক ঘোষণা পত্র ১টি দলিল দিয়ে জায়গাটি দাবী করছেন। আকলিমা বলছেন, হেবায় উল্লেখিত জায়গা ও মালিক রূনা নয়। এ বিষয়ে আদালতে মামলা চলছে। বেশ কয়েক বছর আগে চুন্টার দলিল লেখক শাহিনুর রহমান শাহিনের বিরূদ্ধে একই এলাকার মাসুদুর রহমান জাল দলিল সৃজনের অভিযোগ করলে শাহিন কারা ভোগ করেন। এ ছাড়াও খাজনার রশিদ টেম্পারিং ও নাবালককে সাবালক দেখিয়ে দলিল নিবন্ধনের দায়ে ২/১ জন লেখককে কর্তৃপক্ষের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। অরূয়াইল ও পাকশিমুলে ব্যক্তি মালিকানা জায়গার চেয়ে সরকারি জায়গা ও নদী দখলের প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিনের। দখলের সময় সেখানে সকল দল এক। দখল ঠিকিয়ে রাখতে তারা সাবেক ইউএনও মো. এমরান হোসেনের নামেও মামলা করেছেন। দাঙ্গা তো মামুলি বিষয়। সেখানকার ৩০ নদী দখলদারের বিরূদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করেছিলেন। কিছুটা সরব হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আবার নীরব। 

শাহবাজপুর, শাহজাদাপুর ও পানিশ্বর ইউনিয়নে ভূমি নিয়ে এমন জাল জালিয়াতি, মামলা ও দাঙ্গা হাঙ্গামার ঘটনা ঘটছে। সরাইল সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের সাবেক জনৈক সাব-রেজিষ্ট্রার বলেন, সরাইলে ৫-৬ জন দলিল লেখক জাল দলিল সৃজনসহ নানা অনিয়মে জড়িত। আমার সময়ে এস.এম বাবুল নামের এক লেখক খাজনার রশিদ টেম্পারিং এর দায়ে শাস্তি ভোগ করেছেন। অনেককে সতর্ক করেছি। সকল লেখককে এই সকল অনিয়ম পরিহার করা উচিৎ।    

 

সরাইল উপজেলা দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সোহরাব মিয়া জানান, লেখক আবু বক্করের জাল দলিলের সাথে যুক্ত। মামলা হয়েছে। লাইসেন্স বাতিল হয়েছে কিনা আমি নিশ্চিত নয়। ভূমির জাল জালিয়াতির সাথে দলিল লেখকরা যুক্ত থাকার বিষয়টি খুবই দু:খজনক। গুটি কয়েক লেখকের অপকর্ম আমাদের সকলের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। এ ছাড়া রায়হান নামের লেখক একটি দলিল রেজিস্ট্রি করতে গেলে তৎকালীন সাব-রেজিষ্ট্রার জালিয়াতি ও বিতর্কিতের অভিযোগ থাকায় ফিরিয়ে দেন। কিন্তু রায়হান কৌশলে টিপ নিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করে ফেলেন। ফলে শাস্তি হিসেবে প্রায় এক মাস তার দলিল রেজিস্ট্রি বন্ধ ছিল। আমরা সকলে স্যারকে বুঝিয়ে বিষয়টি সমাধান করেছি। এসব বিষয়ে সরাইল উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রার মো. খেনায়েত উদ্দিন বলেন, এসিল্যান্ডের পত্র অমান্য করে সারোয়ার আইন পরিপন্থী কাজ করেছে। বায়না করেছে তবে রেজিষ্ট্রি করতে পারবে না। সকল প্রকার অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে আমি জিরো টলারেন্স। আমি লেখক রায়হানকে অফিসে আসতে দিচ্ছি না। 

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে