বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দেশের রপ্তানি আয়ের প্রাণকেন্দ্র। এই খাত বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, যা জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতে যে অস্থিরতা ও সংকটের ইঙ্গিত মিলছে, তা উদ্বেগজনক। বিজিএমইএ’র সাম্প্রতিক তথ্যমতে, গত এক বছরে অন্তত ২৫৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং এক লাখের বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন-এটি শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, দেশের রপ্তানি খাতের ভেতরে চাপের গভীর চিত্র। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি, উৎপাদন ব্যয়ের ক্রমবৃদ্ধি, বৈশ্বিক বাজারে অর্ডার হ্রাস, এবং নতুন শ্রম আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের অনিশ্চয়তা-সব মিলিয়ে শিল্প খাতটি এক জটিল বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শিল্পমালিকদের দাবি, বিদেশি প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা বিবেচনা না করেই শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে, যার ফলে মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে মাত্র ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিধান শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে শ্রমিকদের পক্ষে যুক্তি হলো-দীর্ঘদিন ধরেই শ্রম অধিকার, মজুরি কাঠামো ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অতএব, এই আইনি পরিবর্তনকে শুধুমাত্র মালিকপক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলে পূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে না। প্রকৃত প্রয়োজন হলো শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ও শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতার মধ্যে বাস্তবসম্মত ভারসাম্য রক্ষা করা। চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি নিয়েও উদ্যোক্তাদের ক্ষোভ যৌক্তিক মনে হয়। রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যয়বৃদ্ধি দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে আরও দুর্বল করতে পারে, বিশেষ করে যখন পার্শ্ববর্তী দেশগুলো কম খরচে ও দ্রুত বন্দরসেবা দিচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা হারানোর ঝুঁকিও এখন সামনে। এই প্রেক্ষাপটে শিল্পখাতের টিকে থাকার জন্য প্রশাসনিক নীতি, শ্রম আইন ও বাণিজ্য পরিবেশ-সব কিছুই একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া জরুরি। পোশাক খাতের স্থিতিশীলতা শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধির শর্ত। কারখানা বন্ধ হওয়া মানে হাজারো পরিবারের আয়ের উৎস হারানো, বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহে ধাক্কা এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি। তাই এখনই দরকার শিল্পনীতি, শ্রমনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যনীতির মধ্যে সমন্বয় ঘটানো-যেখানে শ্রমিকের অধিকার, বিনিয়োগকারীর আস্থা ও বৈদেশিক বাজারের শর্ত-সবকিছুই ভারসাম্যে থাকবে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অতীতে বহু সংকট পেরিয়ে এগিয়েছে। এবারও তা পারবে, যদি নীতি প্রণয়নে বাস্তবতা, পরামর্শ ও পারস্পরিক আস্থা জায়গা পায়। সময় এখন আবেগ নয়-দূরদর্শিতার।