জুলাই সনদ, ত্রিমুখী রাজনীতি ও অনিশ্চয়তার ফাঁদে বাংলাদেশের নির্বাচন

এসএম হাসানুজ্জামান | প্রকাশ: ৩ নভেম্বর, ২০২৫, ০৪:৪৮ এএম
জুলাই সনদ, ত্রিমুখী রাজনীতি ও অনিশ্চয়তার ফাঁদে বাংলাদেশের নির্বাচন
এসএম হাসানুজ্জামান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূখণ্ডে আবারও অনিশ্চয়তার ঘূর্ণি দেখা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর যে আশা জেগেছিল-একটি অন্তর্বর্তীকালীন নৈতিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের মৌল নীতি পুনর্গঠিত হবে-তা ক্রমেই অনৈক্য, কৌশলগত দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক অবিশ্বাসের চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক “জুলাই সনদ”, যা জাতির কাছে এক নতুন রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে হাজির হয়েছিল, এখন সেই সনদই হয়ে উঠেছে পরস্পরবিরোধী কূটনীতি ও দলীয় স্বার্থের পরীক্ষা ক্ষেত্র। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐকমত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা। “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন”এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতির বিরোধাভাস দূর করে এক সেতুবন্ধন তৈরি করা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি-যা ঐক্যের চেয়ে বিভাজনকে বেশি চেনে-সেই কমিশন গঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন বিরোধের সূচনা করে। ঐকমত্যের দর্শন পরিণত হলো রাজনৈতিক স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, আর জুলাই সনদ পরিণত হলো দলীয় স্বার্থের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রফলে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি-এই তিন দল এখন এই সনদের বাস্তবায়ন ঘিরে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে। বিএনপি অনড়, তাদের দাবি গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিনেই হতে হবে, যাতে জনগণের মতামত সরাসরি নির্বাচনের বৈধতার সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্যদিকে জামায়াতের দাবি নভেম্বরে, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করতে হবে, নচেৎ জনগণের “ইসলামী-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা”অবজ্ঞাত থাকবে। আর এনসিপি বলছে-সময় নয়, প্রক্রিয়াই মুখ্য; গণভোট যে-কোনো সময় হতে পারে, যদি সেটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হয়। এই তিনটি অবস্থান শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির তিনটি দর্শনকে প্রতিফলিত করছে-আস্থাহীনতা, কৌশল, এবং সুবিধাবাদী বাস্তবতা। 

জুলাই সনদের দর্শন মূলত নৈতিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ওপর দাঁড়ানো। সেখানে সুশাসন, জবাবদিহিতা, নিরপেক্ষ নির্বাচন, এবং জনগণের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু দলগুলো সেই নৈতিক দলিলকে নিজেদের স্বার্থে ছেঁটে ফেলছে। বিএনপি মনে করে কমিশন সরকারের স্বার্থে কাজ করছে; জামায়াত সনদকে ব্যবহার করছে ইসলামী পুনরুত্থানের হাতিয়ার হিসেবে; আর এনসিপি সেটিকে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার রাজনৈতিক ব্র্যান্ডে রূপ দিতে চায়। ফলে একই দলিল তিনটি বিপরীত ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে ঐক্যের দলিল হয়ে উঠেছে অনৈক্যের মঞ্চ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে “আস্থা”একটি বিলুপ্তপ্রায় শব্দ। স্বাধীনতার পর থেকেই দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতার রাজনীতি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সেখানে জাতীয় স্বার্থ সবসময় গৌণ। জুলাই সনদ সেই পুরোনো ইতিহাসে পরিবর্তন আনতে পারত-যদি দলগুলো সত্যিকার অর্থে জনগণনির্ভর রাজনৈতিক নৈতিকতায় বিশ্বাস করত। কিন্তু বর্তমানে যা ঘটছে, তা হলো সনদের রাজনৈতিক “প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ”-অর্থাৎ জনগণের অংশগ্রহণ নয়, প্রশাসনিক কাঠামোর নির্দেশে তার বাস্তবায়ন। এর ফলে কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, বিশেষত তাদের নিরপেক্ষতা ও প্রভাবের সীমা নিয়ে। বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রকাশ্যেই বলেছেন, কমিশনের প্রস্তাব জাতিকে ঐক্য নয়, বরং বিভাজনের পথে ঠেলে দিচ্ছে। জামায়াতের গোলাম পরওয়ার বলছেন, গণভোটের তারিখ ঘোষণায় বিলম্ব জাতীয় নির্বাচনকে সংকটে ফেলবে। আর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর মতে, “গণভোট কখন হবে, সেটি প্রশ্ন নয়; বরং তা কীভাবে হবে, সেটিই মুখ্য।” এই বক্তব্যগুলোর সমষ্টিই প্রমাণ করে, রাজনীতির আড়ালে এক নীরব সংঘর্ষ চলছে-ক্ষমতার নকশা নিয়ে। অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ, প্রশাসনিক নিয়োগ নিয়ে তর্ক, এমনকি পরস্পরকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেওয়ার প্রবণতা-সব মিলিয়ে রাজনৈতিক ঐক্যের যে ক্ষণস্থায়ী আবহ তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে। জুলাই সনদের আত্মা ছিল সংলাপ; কিন্তু এখন সংলাপ প্রতিস্থাপিত হয়েছে বক্তৃতায়, আর বক্তৃতা পরিণত হয়েছে পরস্পরবিরোধী কৌশলের প্রদর্শনীতে। রাজনীতির এই অনৈক্য কেবল নির্বাচনের দিনপঞ্জি বা গণভোটের সময়সূচির প্রশ্ন নয়; এটি রাষ্ট্রের নৈতিক কাঠামো নিয়েও প্রশ্ন তোলে। অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সরকারের নৈতিক বৈধতা কেবল নিরপেক্ষ আচরণের মাধ্যমেই টিকে থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সরকারের কর্মকাণ্ড-বিশেষত কমিশনের কার্যক্রম ও প্রশাসনিক নিয়োগে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ-এই নিরপেক্ষতার দাবি দুর্বল করছে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করা কিছু বাম দলও বলছে, এই সনদ প্রকৃত গণতন্ত্রের দলিল নয়, বরং এটি এক নতুন রাজনৈতিক মরীচিকা। গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি যেমন বলেছেন, “নির্বাচিত সরকার বৈধতা না দেওয়া পর্যন্ত জুলাই সনদ বৈধ নয়।” অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরের অভিযোগ, “জুলাই সনদের নামে ড. ইউনূস বড়ো দলগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন, ছোট দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।” এই বক্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায়-সনদ বাস্তবায়নের রাজনৈতিক ঐকমত্য এখন বিভাজনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আত্মবিশ্বাস থাকলেও বাস্তবে প্রশ্ন উঠছে, নির্বাচন আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে কি না। অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক আস্থা বজায় রাখা। কারণ একটি নির্বাচনের সাফল্য কেবল কারিগরি নয়, তা রাজনৈতিক বিশ্বাসের ওপরও নির্ভরশীল। যদি রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে সরকার কোনো নির্দিষ্ট পক্ষের স্বার্থে কাজ করছে, তাহলে নির্বাচন আগেই তার নৈতিক ভিত্তি হারাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ যথার্থই বলেছেন, “প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন-এটা হঠকারী নয়, বরং সুপরিকল্পিত। তিনি দলগুলোর মানসিক কাঠামো বুঝে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই বোঝাপড়ার মধ্যে কি রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিমিতি আছে? বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির বর্তমান অবস্থান প্রমাণ করছে, রাজনৈতিক দলগুলো এখন আর জাতীয় ঐক্যের মনস্তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়; তারা বিশ্বাস করে “অবস্থান”ুএর রাজনীতিতে-যেখানে আপোশ নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাই টিকে থাকার মাধ্যম। রাজনীতির এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার পেছনে রয়েছে ক্ষমতার স্থায়ী কাঠামো। গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণ চেয়েছিল নৈতিক জাগরণ, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সেটিকে রূপ দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দরকষাকষিতে। এর ফল, গণতন্ত্রের যে মানবিক স্বপ্ন ছিল-অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-তা এখন পরিণত হয়েছে সন্দেহ, ষড়যন্ত্র ও কৌশলের ত্রিভুজে। জুলাই সনদের ত্রিমুখী ব্যাখ্যা আসলে তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক ভাষার সংঘর্ষ: বিএনপি রাষ্ট্রীয় বৈধতা চায়; জামায়াত চায় ধর্মীয় গণতন্ত্রের স্বীকৃতি; এনসিপি চায় বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা। তিনটি ভাষা, তিনটি উদ্দেশ্য, কিন্তু রাষ্ট্র একটি। এই বহুভাষিক রাজনীতি রাষ্ট্রীয় নীতিকে টুকরো করছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে-এই বিভাজনের শেষ কোথায়? নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মাত্রাও তত বাড়ছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যদি রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে যে কোনো ফলাফলই হবে বিতর্কিত। আর একবার যদি নির্বাচন বিতর্কিত হয়, রাষ্ট্র আবারও প্রবেশ করবে সেই পুরোনো চক্রে-অরাজকতা, প্রতিবাদ, সহিংসতা ও বৈধতার সংকটে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যেমন সতর্ক করেছেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হবে।”বাংলাদেশের রাষ্ট্র এখন দাঁড়িয়ে আছে এক নৈতিক সংযোগস্থলে-যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু প্রশাসনিক নয়, নৈতিকও। অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য হতে চায়, তবে তাকে এখনই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন গড়তে হবে, আর জুলাই সনদকে পুনরায় ঐকমত্যের দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যথায় এই সনদ ইতিহাসে যোগ হবে আরেকটি অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হিসেবে-যেমন ছিল ১৯৯০ সালের পর একাধিক চুক্তি ও সমঝোতার ব্যর্থতা। জুলাই সনদকে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথম শর্ত হলো বিশ্বাস, দ্বিতীয় শর্ত স্বচ্ছতা, তৃতীয় শর্ত নৈতিকতা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই তিনটির কোনোটি দৃঢ়ভাবে দেখা যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচন রাজনীতি এখন একটি অদ্ভুত অবস্থায়-যেখানে নির্বাচন কেবল একটি ইভেন্ট নয়, বরং এক নৈতিক জটিলতার প্রতীক। রাজনীতিতে নৈতিকতা হারালে গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যায়। জুলাই সনদ যদি এই দেশের নতুন প্রজাতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক হতে চায়, তবে তাকে দলীয় কৌশল, সাময়িক লাভ ও প্রশাসনিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। নইলে আগামী নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক নয়, নৈতিক সংকটেরও প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠবে-যেখানে জনগণের ভোট নয়, বরং দলীয় অবস্থান নির্ধারণ করবে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সংকটের দরজায় দাঁড়িয়ে-ঐকমত্যের ব্যর্থতা যদি পুনরায় ইতিহাস হয়ে যায়, তবে আগামী নির্বাচন শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, রাষ্ট্রের আদর্শিক চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলবে। জুলাই সনদের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল বিভাজনের অবসান, কিন্তু বাস্তবে সেটিই এখন বিভাজনের প্রতীক। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের অবস্থানের বাইরে রাষ্ট্রকে দেখতে না শেখে, তাহলে বাংলাদেশ আরও একবার প্রবেশ করবে অনিশ্চয়তার এক দীর্ঘ অন্ধকারে।

লেখক: এসএম হাসানুজ্জামান; অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে