বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে প্রতিদিন যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, তা আর শুধু দুর্ঘটনা নয়-এ যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক বিপর্যয়। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যান্ত্রিক ত্রুটি, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, অদক্ষ চালক, দুর্নীতি, অবৈধ যানবাহন ইত্যাদি বহুবার আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এক ভয়াবহ বাস্তবতা এখনও নীতিনির্ধারকদের নজরের বাইরে রয়ে গেছে -চালকের স্বাস্থ্যগত অযোগ্যতা। সামপ্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে চালকদের মধ্যে ৭৯ শতাংশই শারীরিকভাবে ‘আনফিট’। এই তথ্য শুধু উদ্বেগজনক নয়, এটি সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক গভীর ফাঁকও প্রকাশ করে। ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এবং বাংলাদেশ মেডিকেল স্টুডেন্টস সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে ৯৩৬ জন চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ চালক দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছেন, ৬২ শতাংশের রয়েছে ডায়াবেটিস, এবং অনেকের রয়েছে উচ্চরক্তচাপ। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে হঠাৎ জ্ঞান হারানো, দৃষ্টিভ্রম বা স্নায়বিক জটিলতা দেখা দিতে পারে-যা চলন্ত গাড়িতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। অথচ এই স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি সড়ক নিরাপত্তা নীতিতে এখনও প্রাধান্য পাচ্ছে না। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৩৫ হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই মারা গেছেন প্রায় ৫ হাজার। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এটি প্রতিটি পরিবারে ঘটে যাওয়া শোকগাথা। চালকের স্বাস্থ্যগত অযোগ্যতা যদি এসব মৃত্যুর একটি বড় কারণ হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এখানে প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে এত সংখ্যক ‘আনফিট’ চালক প্রতিদিন সড়কে গাড়ি চালাচ্ছেন? এর পেছনে রয়েছে দুর্বল লাইসেন্সিং ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরীক্ষার অনুপস্থিতি, এবং পরিবহণ খাতে দুর্নীতির বিস্তার। বুয়েটের গবেষণা অনুযায়ী, নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরে প্রায় ৭০ লাখ অবৈধ তিন চাকার যানবাহন সড়কে চলছে, যেগুলোর চালকদের দক্ষতা বা স্বাস্থ্যগত অবস্থা যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা শুধু আইন প্রয়োগে নয়, চালকের স্বাস্থ্য ও দক্ষতা নিশ্চিত করেও করতে হবে। সমাধান হিসেবে চালকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। লাইসেন্স নবায়নের সময় স্বাস্থ্যগত মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে। চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম, মানসিক প্রশান্তি এবং জীবনমান উন্নয়নের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবহণ মালিকদেরও এ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি, সড়কে নিয়ম ভঙ্গকারীদের তাৎক্ষণিক জরিমানা, অবৈধ যানবাহন উচ্ছেদ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, এটি একটি সমন্বিত মানবিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ। চালকের চোখের দৃষ্টি যদি ঝাপসা হয়, তার সিদ্ধান্তও ঝুঁকিপূর্ণ হয়। তাই সড়কে প্রাণ রক্ষায় চালকের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে-এখনই, না হলে প্রতিদিনই আমরা হারাবো আরও কিছু অমূল্য জীবন।