কালীগঞ্জে

মনোবাসনা পূরণে শত শত মানুষ বটবৃক্ষের ঝুরিতে বেঁধে যান রং-বেরং পলিথিন

এফএনএস (টিপু সুলতান; কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ) : | প্রকাশ: ৫ নভেম্বর, ২০২৫, ০১:৩৫ পিএম
মনোবাসনা পূরণে শত শত মানুষ বটবৃক্ষের ঝুরিতে বেঁধে যান রং-বেরং পলিথিন

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারে গাজী কালু-চম্পাবতীর মাজার অবস্থিত। গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারের গা ঘেঁষে ৬টি ছোটবড় বটবৃক্ষ। প্রতিটির গোড়া শান দিয়ে ঘেরা। গাছ থেকে ঝুলে আছে ঝুরি। সেই ঝুরিতে, ডালে এবং পাশের আরও দুটি ভিন্ন বৃক্ষে শোভা পাচ্ছে নীল, সাদা,লাল, খয়েরি বা কালো নানা রঙের চিকন চিকন পলিথিন-সুতোর মতো করে গাঁথা। মনোকামনা পূরণে একধরনের বিশ্বাসী মানুষ এগুলো বেঁধে রাখেন। তবে দেশ-বিদেশের অন্যসব মাজার বা স্মৃতিস্তম্ভে দেখা যায় মানতকারী লোকজন সুতো বাঁধে-আর এখানে পলিথিন দিয়ে সুতোর মতো করে বাঁধা হয়েছে। পলিথিন সুতোর চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বলেই এই ব্যবস্থা কি না-কে জানে। 

মাজারের আসা মানতকারীরা বলেন, মানুষজন বিভিন্ন মানত করে এগুলো বেঁধে রাখেন। তাদের ধারণা, এই মাজারের বদৌলতে তাদের কামনা বাসনা পূরণ হবে। তবে মনের আশা পূরণের এই পলিথিন তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন এনেছে কি না জানতে পারিনি। গাজী কালু ও চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তী।জনশ্রুতিতে আছে,তৎকালীন বিরাটনগরের শাসক দরবেশ শাহ্ সিকান্দারের ছেলে গাজী, আর কালু হচ্ছেন সিকান্দারের পোষ্য ছেলে। কালু তার পালক পিতার সন্তান গাজীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সর্বত্র তার সঙ্গী হতেন। একদিন গাজীর সঙ্গে ছাপাইনগরের সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার কন্যা চম্পাবতীর দেখা হয়। চম্পাকে দেখে গাজী আর চম্পাবতীও গাজীকে দেখে ভুলে গিয়েছিলেন স্থান-কাল-পাত্র ও বাস্তবতা। চম্পাবতী ভুলে যান তিনি হিন্দু রাজার মেয়ে আর গাজীও ভুলে যান তিনি মুসলমান শাসকের পুত্র। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বাভাবিক নিয়মে তাদের মিলনের মাঝে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা। মুকুট রাজা তার সেনাপতিদের হুকুম দেন, গাজী ও কালুকে শায়েস্তা করতে। যুদ্ধে মুকুট রায়ের সেনাপতি দক্ষিণা রায় পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে গাজীর অনুসারী হন। গাজী-কালু ও চম্পাবতীর মাজারের সাথে দক্ষিণা রায়ের মাজারও আছে।গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজারে হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করে। শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাশে ৩টি পাশাপাশি কবরের অবস্থান। মাঝখানে বড় কবরটি গাজীর,পশ্চিমেরটি কালুর এবং পূর্বের ছোট কবরটি চম্পবতীর বলে পরিচিত। মাজার সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে।এই বটগাছের তলদেশে একটি শূণ্যস্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে প্রাচীন কূপ কিংবা অন্য কোনও কবর বলে মনে করেন।  ১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কবর তিনটি বাঁধাই করে বেষ্টনি প্রাচীর নির্মাণ ও খাদেমদের থাকার জন্য সেমিপাকা টিনশেড তৈরি করে দেয়। তবে বাংলাদেশের শহর-গ্রামে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত গাজী-কালু-চম্পাবতীর গল্প-কাহিনীর সত্যাসত্য নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ-ইতিহাসবিদদের অনেক মতভেদ আছে।প্রতিদিন প্রচুর ভক্ত আর দর্শনার্থী আসেন মাজার দর্শনে। আজকে দর্শনার্থী বলতে আমরাই, বাকিরা ভক্ত। মাজারে প্রবেশের আগে পাশের দোকান থেকে আগরবাতি, মোমবাতি আর সুতা কিনে নিচ্ছেন এখানে আসা ভক্তরা। মোমবাতি মাজারের খাদেমের হাতে দেওয়ার জন্য। আর আগরবাতি প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের ডালে বেঁধে মানত করে জ্বালিয়ে দেবেন। ভক্তদের বিশ্বাস মানত পূর্ণ হবে। আর সেদিন তারা এসে সেই সুতা খুলে নেবেন। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। মানত পূর্ণ না হয় হলো, কিন্তু সেই হাজারো সুতার ভিড়ে নিজের বাঁধা সুতা চিনবে কী করে।গাজী-কালুর কথা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জনশ্রুতি আছে গাজী কালুর আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘে ও কুমির একঘাটে জল খেত, গাজী কালু এমনই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক চরিত্র। হিন্দু ধর্মবলম্বলীরা বনদূর্গার বদলে যাদের পূজা করে তাদের মধ্যে গাজী-কালু অন্যতম। গাজী-কালুকে নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত। অনেক কবিতা ও পুঁথির মাধ্যমে তার ভাব প্রকাশ হয়েছে যুগে যুগে আসলে ইতিহাস সন্ধান আমার কাজ না হলেও সে সব বাদ দিয়ে চলা মুস্কিল।

হাফেজ জুনাইদ হাসান বলেন, মাজারে বা কোনো গাছে সুতা,তাবিজ,পলিথিন বাঁধা ইসলামে জায়েজ নেই,এটি শিরকের একটি রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়।ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে,তাবিজ,সুতা,বাএ ধরনের কোনো বস্তু ঝুলানো বা বাঁধা হারাম।নবীজি(সাঃ) বলেছেন,যে ব্যক্তি কোনো জিনিস ঝোলাবে, তাকে সেই জিনিসের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হবে। 

মাজারের সামনে স্থাপিত একটি শিলালিপিতে উল্লেখ আছে গাজী-কালু-চম্পাবতীর বিষয়ে যেসব বিবরণ পাওয়া যায় তা সবই ঐতিহাসিক উপাখ্যান এবং গাজীর গীত, উপন্যাস, পুঁথি সাহিত্য,কিংবদন্তী, জনশ্রুতি বা স্থানীয় প্রবাদ সর্বস্ব। সুতরাং গাজীর ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করা দুরূহ ব্যাপার। তবে সিলেট থেকে সুন্দরবন হয়ে গাজী নামে যে আধ্যাত্মিক সাধক বারোবাজার বা ছাপাইনগরে এসে হাজির হন তিনি বহু বৌদ্ধ ও হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেন। যশোর জেলায় তার আগমনকাল নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এতটুকু বলা যায় যে, গাজী, কালু, চম্পাবতী কিংবদন্তী কিংবা বাস্তবতায় তারা কালীগঞ্জের বারোবাজার থেকেই সর্বপ্রথম ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিলেন গোটা দক্ষিণ বাংলায়।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে