শেরপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে খেরুয়া মসজিদ

এফএনএস (সৌরভ অধিকারী শুভ; শেরপুর, বগুড়া) : | প্রকাশ: ৫ নভেম্বর, ২০২৫, ০৮:৪২ পিএম
শেরপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে খেরুয়া মসজিদ

বগুড়ার প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন খেরুয়া মসজিদ। অবস্থানগত দিক থেকে এটি শেরপুর উপজেলা শহরের থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত শাহ্-বন্দেগী ইউনিয়নের খন্দকারটোলায়। নবাব মির্জা মুরাদ খান কাকশালের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত মসজিদটির স্থাপনার গায়ে স্থাপিত ফার্সি শিলালিপিতে লেখা আছে। সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে নির্মিত মসজিদটির নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি।

সবুজ ঘাসে ছাওয়া মসজিদটির চারপাশ সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে নির্মিত এই খেরুয়া মসজিদের বর্তমানে সংস্কারের অভাবে বেহাল দশা দেখা দিয়েছে। মসজিদের তিনটি গম্বুজেই ফাটল ধরেছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ফাটলের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে বৃষ্টির পানি পড়ে। এতে মুসল্লিদের নানারকম বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঐতিহাসিক এই মসজিদের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার তিন যুগেও নতুন করে কোনো সংস্কার কাজ হয়নি।

৫৯ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত মসজিদের পুরো অংশ। ইটের দেয়ালের ওপরটা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। মূল গেটের কাছেই রয়েছে বেশ বড় একটি সাইনবোর্ড। বাংলা ও ইংরেজিতে এতে লেখা আছে মসজিদের ইতিহাস। রং উঠে যাওয়ায় বোর্ডের লেখার পাঠোদ্ধার করা যায় না। তবে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ‘ঐতিহ্যের স্বরূপ সন্ধানে’ এবং অধ্যক্ষ মুহম্মদ রোস্তম আলীর ‘শেরপুরের ইতিহাস (অতীত ও বর্তমান)’ থেকে পাওয়া যায় মসজিদটির সংক্ষিপ্ত নির্মাণ ইতিহাস। তখন ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। স্থানীয় বুজুর্গ ফকির আবদুস সামাদ একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। সে সময়ে এখানকার প্রাদেশিক জায়গিরদার মির্জা মুরাদ খান কাকশালের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। দিল্লির মসনদে তখন আসীন মুঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন আকবর। ১৫৮২ সালে তিনি দ্বীনে এলাহি প্রতিষ্ঠা করলে বাংলার কিছু অঞ্চলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। মির্জা মুরাদ খান কাকশালও যোগ দেন সম্রাটের বিদ্রোহীদের দলে। এই বিদ্রোহের সময় বন্ধ থাকে মসজিদ নির্মাণ কাজ। শেষ পর্যন্ত মুরাদ খান সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হন। সম্রাটের আনুগত্য মেনে নেওয়ার পর আবারও শুরু হয় খেরুয়া মসজিদের নির্মাণকাজ। ফলে প্রায় পাঁচ বছর লেগে যায় মসজিদটির নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে।

মসজিদটি একটি আয়তাকার স্থাপত্য। এর দৈর্ঘ্যরে পরিমাণ ১৭.৬৭ মিটার এবং প্রস্থ ৭.৬২ মিটার, দেয়ালের পুরুত্ব ১.৯৫ মিটার। মসজিদটির পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশদ্বার আছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারটি অন্য প্রবেশদ্বারের তুলনায় বড় ও প্রশস্ত। প্রতিটি প্রবেশপথ একেবারে সুস্পষ্ট। মসজিদের অভ্যন্তরে পূর্ব দেয়ালের প্রবেশদ্বারের সঙ্গে মিল রেখে তিনটি মেহ্রাব আছে। আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে অর্ধগোলাকার মেহ্রাবগুলো স্থাপিত। মেহ্রাবের কারুকার্যগুলো মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই সুন্দর। মসজিদের চতুর্দিকে চারটি অষ্টাভুজ আকৃতির মিনার আছে, যা ছাদ পর্যন্ত উত্থিত। এগুলো মসজিদের কাঠামো আরো সুদৃঢ় করেছে। এই মসজিদের কার্নিসগুলো সুলতানি আমলের স্থাপত্যের মতোই বাঁকানো। কার্নিসেও ছোট ছোট পোড়ামাটির তৈরি কারুকার্য লক্ষ করা যায়। অর্ধগোলাকৃতির গম্বুজগুলোর কার্নিশ ধনুকের মতো বাঁকা। এ ছাড়া মসজিদের চার কোণে রয়েছে আটকোনা আকৃতির চারটি মিনার।

মসজিদের অভ্যন্তরভাগ তিন অংশে বিভক্ত। ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধগোলাকার কারুকার্যবিশিষ্ট মেহ্রাব। মূল মেহ্রাবের দুপাশে আকারে ছোট দুটি মেহ্রাব রয়েছে। সাদৃশ্য রক্ষার্থেই সেগুলো বানানো হয়েছে। মসজিদের মোট কাতারসংখ্যা তিন। মসজিদটি নির্মাণে চুন ও সুড়কি দিয়ে গাঁথা হয়েছে ইট। এতে বৃহদাকার কৃষ্ণ পাথরও ব্যবহার করা হয়েছে। ইটের বিন্যাস ও খাড়া প্যানেলের মাধ্যমে নান্দনিক বৈচিত্র্য তৈরি করা হয়েছে মসজিদটিতে। এর দেয়ালের গাঁথুনিগুলো অসম্ভব নান্দনিক। মিনার, গম্বুজ, নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি এবং ফুল, লতাপাতার নকশার কারণে পুরো মসজিদই নজর কাড়ে।

খেরুয়া মসজিদের নামকরণ স্পষ্ট নয়। আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া তার ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘মসজিদটি খেরুয়া বলে নামকরণের কারণ সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। আরবি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ নেই। তবে ফার্সিতে ‘খায়ের গাহ’ বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ ‘কোনো স্থানের ভেতরে’। রাজা মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার তখন তিনি শেরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গের কোনো অস্তিত্ব এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে মসজিদটি যদি শেরপুর দুর্গের ভেতরে নির্মিত হয়ে থাকে, তবে ‘খায়ের গাহ’ থেকে খেরুয়া নাম হতে পারে বলে অনুমান করা হয়।’

খাদেম আব্দুস সামাদ বলেন, মসজিদটি পরিদর্শনে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষরা আসেন। দর্শনার্থীরা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়ে মুসলিম স্থাপত্য সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। তবে মসজিদে আসার সড়ক মেরামত আর আশপাশে বড় বড় ভবন নির্মাণ বন্ধ করা গেলে পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বাড়বে।

খেরুয়া মসজিদের মোয়াজ্জেম জোবায়ের বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি মসজিদে এখন তারাবির নামাজ ও ঈদের জামাত হয়ে থাকে। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মসজিদ সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। মসজিদের গম্বুজ ফুটো হয়ে বর্ষা মৌসুমে ভেতরে পানি পড়ে। দ্রুত সংস্কার না হলে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এ ব্যাপারে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনজুরুল আলম  বলেন, খেরুয়া মসজিদ প্রায় সাড়ে চার শতাব্দী পুরানো। মসজিদটির বর্তমান অবস্থা অনেকটাই ভঙ্গুরদশায় পরিণত হয়েছে। তবে এটি সংস্কারে উপজেলা প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে