খুলনা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক এম. খাদেমুল ইসলাম। ওয়াসায় যোগদানের আগে তিনি খুলনা পাবলিক কলেজে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পদে কর্মরত ছিলেন। সেখানে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে। কিন্তু বহিস্কারের তথ্য গোপন করে খুলনা ওয়াসায় যোগদান করেন তিনি। তবে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার ছত্র-ছায়ায় থাকায় বিষয়টি কেউ আলোচনায় আনার সাহস করেনি। ফলে বহাল তবিয়তে এবং দাপটের সঙ্গেই ছিলেন তিনি, আছেন এখনও। খাদেমুল নগরীর বয়রা সেন্ট্রাল রোডের মৃত আবুল হোসেন তালুকদারের ছেলে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের পতনের পর খাদেমুল ইসলামের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনসহ আরও অনিয়মের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা অভিযোগ তোলায় তিনি আলোচনায় আসেন। ছাত্র সমন্বয়ক মোঃ মুনসুর আহমেদের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতেও তদন্তও শুরু করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। সে মোতাবেক তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ এবং চাকরিচ্যুতির সত্যতা জানতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পাবলিক কলেজ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন। যার প্রেক্ষিতে পাবলিক কলেজ কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৩১ অক্টোবর (অর্থাৎ এক বছরেরও অধিক সময় আগে) ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে পাল্টা পত্র দিয়ে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেন। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তন পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য আওয়ামী ঈশারায় যেন সেই তদন্ত আর এগোয়নি। লাল ফিতায় ফাইলবন্দী রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, খাদেমুল ইসলামকে রক্ষার নেপথ্যে যার পুরো কলকাঠি নাড়ছেন খুলনা ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস ও উপ- ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঝুমুর বালা। যারা গোপালগঞ্জের বাসিন্দা ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর বলে ওয়াসায় পরিচিত। তাদের ছায়ায় থাকায় তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের তদন্তের বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এম খাদেমুল ইসলাম ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি খুলনা পাবলিক কলেজে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হলে যোগদানের মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ২০১০ সালের ২৪ জুলাই কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে। একই সঙ্গে বিভাগীয় মামলাও দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি চাকরিচ্যুতি ও মামলার তথ্য গোপন করে মাত্র তিন মাসের মধ্যেই একই বছরের ৫ অক্টোবর খুলনা ওয়াসায় বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক পদে যোগদান করেন। তার যোগদানের পেছনে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের খুলনার শীর্ষ দু’ নেতার সুপারিশ ছিল বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের পতনের পর তার এ দুর্নীতির বিষয়টি দীর্ঘ ১৫ বছর পর বড় ইস্যু হিসেবে সামনে আসে। ফলে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ এবং চাকরিচ্যুতির সত্যতা নিশ্চিত হতে ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস স্বাক্ষরিত একটি পত্র ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর পাবলিক কলেজের অধ্যক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘খুলনা ওয়াসায় বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক পদে কর্মরত এম, খাদেমুল ইসলাম, খুলনা ওয়াসায় যোগদানের পূর্বে খুলনা পাবলিক কলেজের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পদে চাকুরীরতকালীন সময়ে কলেজের বিভিন্ন ফান্ড থেকে বিপুল পরিমাণ সরকারী অর্থ আত্মসাৎ করেছেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে। তিনি উক্ত আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরৎ দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিভাগীয় মামলা দায়ের করে তাঁকে সাময়িকভাবে কর্মচ্যুত করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার পদ হতে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হয়েছে। উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মতামত প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এদিকে, ওয়াসার চিঠি পেয়ে পাবলিক কলেজ কর্তৃপক্ষ মাত্র ৯ দিনের মধ্যেই গত বছরের ৩১ অক্টোবর ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে পাল্টা পত্র দিয়ে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেন। পাবলিক কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মোহাম্মদ শামীমুল আহসান শামীম স্বাক্ষরিত মতামতে উল্লেখ করা হয়, ‘হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা খাদেমুল ইসলামের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হলে বিধি মোতাবেক ২০১০ সালের ২৪ জুলাই চাকরি থেকে বহিস্কার করা হয়। পরবর্তীতে এম খাদেমুল ইসলাম সমুদয় অর্থ ফেরত দেন।’
বিষয়টি নিশ্চিত করে কলেজের বর্তমান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আকুঞ্জী মো. শামছুদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, খাদেমুল ইসলাম কলেজে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পদে কর্মরত থাকাকালীন প্রতিষ্ঠানের অর্ধলক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেন। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে, চাকরিচ্যুতির বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন। যা আদালত খারিজ করে দেন। পরবর্তীতে তিনি আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ওয়াসার দেওয়া চিঠির জবাবে সবকিছু উল্লেখ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
কলেজ কর্তৃপক্ষের পত্র অনুযায়ী আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে পাবলিক কলেজ থেকে খাদেমুলের চাকরিচ্যুতির বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষের পত্র প্রাপ্তির দীর্ঘ এক বছরেরও অধিক সময় অতিবাহিত হলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ খাদেমুলের বিরুদ্ধে কোন ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উপরন্তু ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তাকে বহাল তবিয়তে বসিয়ে রেখেছেন। যা ওয়াসার পুরো ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এদিকে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত খাদেমুল ইসলাম খুলনা ওয়াসায় যোগদানের পরও তার চরিত্রগত অপরাধ প্রবণতা থেকে বের হতে পারেনি। যথারীতি এখানেও জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে। এসব অনিয়মে খাদেমুলকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমীর সুলতান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ এরশাদ আহমেদ ও ওয়াসার একজন সহকারী প্রোগ্রামার সোহেল বিল্লাহ সহায়তা করছেন বলেও ছাত্র সমন্বয়কের লিখিত অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
খুলনা ওয়াসার সচিব প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস এ প্রতিবেদককে বলেন, বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক খাদেমুল ইসলাম পাবলিক কলেজ থেকে বহিস্কারের বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষের মতামতে উল্লেখ রয়েছে। সে আলোকে তার বিষয়টি পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অফিসের নথিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন।
কলেজ থেকে মতামত পাওয়ার দীর্ঘ এক বছর পরও কেন ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এরই মধ্যে ওয়াসার তিনজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিবর্তন হওয়ার কারণে বিষয়টি বিলম্বিত হয়েছে। তবে সর্বশেষ বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নথিতে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে, তার বিরুদ্ধে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করে সচিব বলেন, তার কাজ নথিতে উপস্থাপন করা। তিনি সেটিই করেছেন। এখানে কেউ অভিযোগ করলে সেটি তার ব্যাপার।
অভিযোগের বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক খাদেমুল ইসলাম বলেন, তিনি পাবলিক কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে চাকরিতে যোগদান করে মাত্র ৫২ দিন অফিস করেন। সেখানে অনেকেই তার কাছে বিভিন্ন ধরণের অনৈতিক দাবি করতেন। কিন্তু তিনি সেসব দাবি পূরণ না করায় অন্যায়ভাবে তাকে বহিস্কার করা হয়েছে। তবে, ১৫ বছরে এ বিষয়ে কোন কথা হয়নি। এখন কেন বিষয়টি সামনে আসছে- বলে পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি। পুরোনো বিষয় নিয়ে তাকে হয়রানির চেস্টা করা হচ্ছে- উল্লেখ করে বহিস্কারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে তার দায়েরকৃত মামলা খারিজ হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে খুলনা ওয়াসা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্থানীয় সরকার বিভাগ খুলনার পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম বলেন, বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক খাদেমুল ইসলামের বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় সেটির সত্যতা জানতে পাবলিক কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে তারা জবাবও দিয়েছেন। সেটি ফাইলে জমা হয়েছে। এ বিষয়ে বিধি অনুযায়ী কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সেটি আমি আজই (বৃহস্পতিবার) দেখবো। তবে এ বিষয়ে দীর্ঘ সূত্রিতা নিয়ে তিনি নিজেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।