রাজনৈতিক ক্ষোভ জনতার সম্পদে কেন, নেতাদের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার সংঘর্ষ

মো: শামীম মিয়া | প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর, ২০২৫, ০২:২৪ পিএম
রাজনৈতিক ক্ষোভ জনতার সম্পদে কেন, নেতাদের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার সংঘর্ষ
মো: শামীম মিয়া

রাজনীতি-এই শব্দটি শুনলেই মানুষের মনে আসে দেশপ্রেম, নীতি, নেতৃত্ব আর জনকল্যাণের ভাবনা। কিন্তু বাস্তবের রাজনীতিতে সেই মহান আদর্শ আজ বড়োই অনুপস্থিত। ক্ষমতার জন্য লড়াই, প্রতিশোধের রাজনীতি, এবং দলীয় স্বার্থের সংঘর্ষে আজ রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য-জনকল্যাণ-বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা মুখে বলেন, তাঁরা নাকি দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করছেন, কিন্তু যখন তাঁদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, তখন সেই দ্বন্দ্বের প্রথম বলি হয় সাধারণ মানুষ-যার ঘাম ও শ্রমে এই দেশ চলে। প্রশ্ন জাগে, যদি রাজনীতি জনগণের জন্য হয়, তাহলে কেন জনগণের সম্পদ, কর্মসংস্থান ও জীবনধারণের সুযোগগুলোই রাজনীতির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়? বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, এই দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন মানেই জনজীবনের অচলাবস্থা। আন্দোলনের নামে রাস্তায় টায়ার জ্বলে, গাড়ি পোড়ে, দোকানপাট বন্ধ থাকে, দিনমজুরদের আয়ে ছেদ পড়ে। অথচ যারা এসব কর্মসূচির ডাক দেন, তাঁদের জীবনযাপন, আয়-রোজগার, নিরাপত্তা-সবই সুরক্ষিত থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই মানুষটি, যে প্রতিদিনের আয়ে সংসার চালায়, যে সকালে বের হয়ে রিকশা চালায়, দোকানে বসে, বা ভ্যানে মাল টানে। রাজনীতির উত্তাপে তার চুলা নিভে যায়, তার সন্তানের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, তার আশার প্রদীপ অন্ধকারে ঢেকে যায়। রাজনৈতিক ক্ষোভের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এটি কখনও একক ক্ষোভ নয়, বরং এটি হয় সংগঠিত প্রতিশোধ। একটি দল ক্ষমতায় থাকলে আরেক দল প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে। তারা চায় ক্ষমতাকে টেনে নামাতে, যেভাবেই হোক। এই প্রতিশোধের রাজনীতি জনগণের জন্য নয়, বরং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। যখন এই প্রতিশোধ রাজপথে নামে, তখন সেই আগুন আর শুধু প্রতিপক্ষ দলকে পোড়ায় না-পুড়ে যায় দেশ, সমাজ, জনজীবন, অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ। যে দেশটা উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারত, সে দেশ পিছিয়ে পড়ে অনিশ্চয়তা, ক্ষোভ আর ধ্বংসের অন্ধকারে। রাজনীতির মূল দর্শন ছিল জনগণের সেবা, কিন্তু আজ রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থ রক্ষার অস্ত্র। একজন রাজনীতিক এখন নিজের পদ, প্রভাব ও ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তিনি হয়ত বক্তৃতায় বলবেন “দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করছি”, কিন্তু তার দলীয় কর্মীরা তখন হয়ত রাস্তায় পেট্রোল বোমা ছুড়ছে, বা অবরোধের নামে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করছে। এই ভণ্ডামি, এই বৈপরীত্যই আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল ব্যাধি। রাজনৈতিক নেতারা জানেন, জনগণের স্মৃতি ছোট-আজ যদি ক্ষতি হয়ও, কাল নতুন স্লোগানে তারা আবার জড়ো হবে। ফলে জনতার রক্ত-ঘামের মূল্য রাজনীতির কাছে কোনো গুরুত্ব পায় না। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে প্রতিদিন লাখো মানুষ অভাবের সঙ্গে লড়াই করে, সেখানে রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়-এটি সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও ভয়াবহ আঘাত। একদিনের হরতালে দেশের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়, হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারায়, পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়, চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কেউ এই ক্ষতির দায় নেয় না। কোনো দলই বলে না-“জনগণের ক্ষতির জন্য আমরা দুঃখিত।” বরং পরের দিন আবার নতুন কর্মসূচি আসে, নতুন সংঘর্ষ হয়, আর গণমাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক নাটক শুরু হয়। রাজনৈতিক নেতাদের মুখে যখন “দেশের কল্যাণ”শোনা যায়, তখন তা আসলে এক ধরনের মুখোশ। কারণ দেশ মানে তো শুধু সরকার নয়, দেশ মানে মানুষ, জনগণ, শ্রমজীবী শ্রেণি, কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী-সবাই। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন সেই মানুষগুলোর জীবনের ওপর আঘাত হানে, তখন সেটি আর কল্যাণ নয়, বরং ধ্বংসের পথ। রাজনীতি তখন হয়ে দাঁড়ায় মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ। যারা এই দেশে রাজনীতি করছেন, তারা যেন ভুলে গেছেন-ক্ষমতা মানে দায়িত্ব, শোষণ নয়; নেতৃত্ব মানে সেবা, স্বার্থ নয়। রাজনৈতিক ক্ষোভের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিনিয়োগ কমছে, উদ্যোক্তারা বিদেশে পুঁজি স্থানান্তর করছে, কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিল্প-কারখানা অচল, রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত, কৃষক তার পণ্য নিয়ে বাজারে যেতে ভয় পাচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক সংঘর্ষের পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হতে সময় লাগে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সে সময় দেয় না। তারা তাড়াহুড়ো করে আবার নতুন সংঘর্ষে নামে, যেন জনগণের জীবন কোনো মূল্যই বহন করে না। রাষ্ট্রের সম্পদ, জনগণের করের টাকা, সরকারি প্রকল্প-সবই শেষ পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়ে। অথচ এসব ক্ষতির দায় কেউ নেয় না, কেউ ক্ষমা চায় না। রাজনীতির এই অমানবিক বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তরুণ প্রজন্ম। তারা দেখে, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া মানে নীতি নয়, বরং কৌশল; মেধা নয়, বরং চাটুকারিতা; সেবা নয়, বরং ক্ষমতার অংশীদারিত্ব। ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে এক ভয়াবহ সংস্কৃতি-যেখানে নীতিবোধ, শ্রদ্ধা, মানবতা ও দেশপ্রেম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি এখন আর নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্র নয়, বরং প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে ছাত্র রাজনীতিতেও-যেখানে আদর্শ নয়, বরং দলে কে কত বড়ো “নেতা”সেটা নিয়েই সংঘর্ষ চলছে। এই বাস্তবতা একদিকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে ধ্বংস করছে, অন্যদিকে তৈরি করছে এক বিভক্ত প্রজন্ম, যারা দেশ নয়, বরং দলকে ভালোবাসতে শিখছে। তবে এর মাঝেও এখনো আশার আলো আছে। দেশের সাধারণ মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা বুঝতে পারছে-রাজনীতি মানে দল নয়, রাজনীতি মানে নিজের জীবনের নিরাপত্তা, নিজের কর্মস্থল, নিজের ভবিষ্যৎ। তারা দেখছে, যে রাজনীতি তাদের নামে চলে, সেই রাজনীতি তাদেরই ক্ষতি করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে এখন জনমত অনেক শক্তিশালী। মানুষ প্রশ্ন করতে শিখছে-“আমার পেট খালি রেখে যদি রাজনীতি চলে, তবে এই রাজনীতির দরকার কী?”এই প্রশ্নই ভবিষ্যতে পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। কিন্তু এই পরিবর্তন ঘটাতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক আত্মসমালোচনা। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজেদের ভেতরের সংস্কার আনা। আন্দোলন করতে হলে তা হতে হবে অহিংস, গঠনমূলক ও লক্ষ্যনির্ভর। বিরোধিতা করতে হলে তা হতে হবে নীতিগত-মানুষের ক্ষতি করে নয়। সরকারকে বুঝতে হবে, দমননীতি দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত করা যায় না। আর বিরোধী দলকে বুঝতে হবে, রাষ্ট্র ধ্বংস করে রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন আনা যায় না। রাজনীতি যদি সত্যিই দেশের জন্য হয়, তবে সেটি হতে হবে মানুষকেন্দ্রিক, উন্নয়নকেন্দ্রিক এবং মানবিক মূল্যবোধনির্ভর। আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক মানবিকতা-যেখানে একজন নেতা প্রথমে মানুষ, পরে রাজনীতিক। যেখানে নেতৃত্ব মানে সহানুভূতি, যেখানে আন্দোলন মানে উন্নয়ন দাবি, যেখানে প্রতিবাদ মানে চিন্তার প্রকাশ, ধ্বংস নয়। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর, যেখানে ক্ষোভ নয়, সহযোগিতা; প্রতিশোধ নয়, প্রজ্ঞা; বিভাজন নয়, ঐক্য হবে মূল শক্তি। অতএব, সময় এসেছে এই প্রশ্নের জবাব রাজনীতিকদের নিজেদের কাছেই খুঁজে নিতে-কেন তাঁদের ক্ষোভে পুড়ে যায় জনগণের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, জীবন-জীবিকা? কেন তাঁদের প্রতিশ্রুত “জনকল্যাণ”শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় “জনদুর্ভোগে’’? যত দিন পর্যন্ত রাজনীতি মানবতার পথে না ফিরে, তত দিন এই দেশ কখনো সত্যিকারের উন্নয়ন ও কল্যাণের পথে ফিরতে পারবে না। কারণ, জনগণের সম্পদ ও কর্মস্থল ধ্বংস করে কোনো রাজনীতিই জাতির মুক্তি দিতে পারে না। 

লেখক: মো: শামীম মিয়া; কলামিস্ট