রাজনীতি, ছাত্র ও শিক্ষক দেশের মেধা ও বৌদ্ধিক বিকাশের সংকট

মো: শামীম মিয়া | প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর, ২০২৫, ০৫:৫৩ পিএম
রাজনীতি, ছাত্র ও শিক্ষক দেশের মেধা ও বৌদ্ধিক বিকাশের সংকট
মো: শামীম মিয়া

দেশীয় শিক্ষাক্ষেত্রের সাম্প্রতিক অবস্থা একটি গভীর সংকটের পরিচায়ক, যেখানে ছাত্র, শিক্ষক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের জটিল আন্তঃসম্পর্ক দেশের বৌদ্ধিক সম্ভাবনা ও মেধার বিকাশকে ক্রমশ ক্ষয় করছে। শিক্ষাবিদীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি শুধুমাত্র শিক্ষার মানহ্রাস নয়, বরং একটি সামাজিক, নৈতিক এবং মানসিক সংকট, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় প্রতিভার ধ্বংস, সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। শিক্ষার শৃঙ্খল এবং মেধার অগ্রগতিকে যদি রাজনৈতিক স্বার্থ, শিক্ষকবৃন্দের দায়িত্বহীনতা এবং ছাত্রজীবনের বিপথগামী ক্রিয়াশীলতা দ্বারা প্রভাবিত করা হয়, তবে তা দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদকে অভ্যন্তরীণভাবে ক্ষয় করে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকে সীমিত করে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা একসময় জাতির আশা ও ভবিষ্যতের প্রতিভা হিসেবে পরিচিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল মেধা বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান অর্জন করত না, বরং বিশ্লেষণক্ষমতা, সামাজিক সচেতনতা, নৈতিকতা এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বিকাশের সুযোগ পেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, ছাত্ররাজনীতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শিক্ষার্থীর মননশীলতা ও সৃজনশীল বিকাশকে ক্রমশ ক্ষয় করছে। শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষাজীবনকে রাজনৈতিক দলের স্বার্থপর কর্মকাণ্ড এবং ক্ষমতার মঞ্চ হিসেবে গ্রহণ করছে। এতে তারা স্বাধীন চিন্তাশীলতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং উদ্ভাবনী মননশীলতা বিকাশের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সুযোগ হারাচ্ছে। ছাত্ররাজনীতি, যা মূলত নেতৃত্ব, সংগঠন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা বিকাশের একটি মাধ্যম, তা এখন প্রায়শই সহিংসতা, সংঘাত এবং পার্টি-ভিত্তিক প্রভাবের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রশাসনিক অনিয়ম, ভবিষ্যতের অস্থিরতা-এই সব মিলিয়ে তারা আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের মেধার আধার ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং মননশীলতা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে এই রাজনৈতিক প্রভাব। শিক্ষক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরা কেবল জ্ঞান প্রদানের মাধ্যম নয়; তারা শিক্ষার্থীর নৈতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের দিশারি। শিক্ষকের দায়িত্ব শুধুমাত্র পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করা নয়; শিক্ষার্থীর অন্তর্দৃষ্টি, উদ্ভাবনী মনন এবং নৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। তবে রাজনৈতিক চাপ, স্বার্থান্বেষী প্রশাসনিক নির্দেশনা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ শিক্ষকদের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে। অনেক শিক্ষক আজ পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করলেও শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারছেন না। বিশেষত গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে এই পরিস্থিতি আরও গুরুতর। শিক্ষকের দায়িত্বহীনতা শিক্ষাক্ষেত্রে মানহ্রাস ঘটাচ্ছে এবং দেশের মেধার ক্ষয় নিশ্চিত করছে। শিক্ষার্থীরা উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা, মননশীলতা এবং বৌদ্ধিক আত্মনির্ভরতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় মেধার অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে। রাজনীতি, যা স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্র এবং জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য, শিক্ষাক্ষেত্রে অযাচিতভাবে প্রবেশ করলে তা শিক্ষার্থীর বিকাশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শিক্ষার্থীর মননশীলতা এবং স্বাধীন চিন্তাশীলতা সীমিত করে, যা শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি কেবল শিক্ষার্থী বা শিক্ষক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি জাতীয় গবেষণা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও প্রভাবিত করছে। মেধাবী তরুণরা যদি সঠিক শিক্ষার সুযোগ, উৎসাহ এবং স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ না পায়, তবে দেশের মানবসম্পদ ধ্বংসের পথে চলে যায়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর নৈতিকতা, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং সৃজনশীল মননশীলতা বিকাশের মাধ্যমে তাদের সক্ষম নাগরিক হিসেবে গঠন করা। কিন্তু আজকের শিক্ষার্থী রাজনৈতিক প্রভাব, পার্টি লয়ালটি এবং সামাজিক প্রভাবের কারণে তার অন্তর্দৃষ্টি বিকাশের পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে দেশে বৌদ্ধিক শক্তি ক্ষয় পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররাজনীতি প্রায়শই সহিংসতা, সংঘর্ষ এবং পার্টি-ভিত্তিক দখলের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পার্টির স্বার্থ বা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য উৎসর্গিত হচ্ছে। শিক্ষকরা এই সংকটের দ্বিতীয় স্তম্ভ। শিক্ষকেরা যদি শিক্ষার মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হন, শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা এবং বৌদ্ধিক বিকাশ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষত, গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলের স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষকরা রাজনৈতিক চাপের কারণে শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে যথাযথ মনোযোগ দিতে পারছেন না। ফলে দেশের মেধাবী ছাত্রদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় মেধার ক্ষয় নিশ্চিত করছে। রাজনীতির প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রে সীমিত না হলে, এটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রগতিকেও প্রভাবিত করে। শিক্ষার্থীরা যদি রাজনৈতিক কারণে সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ না পায়, তবে গবেষণা, উদ্ভাবনী মননশীলতা এবং সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এই সংকট দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদ ক্ষয় এবং দেশের ভবিষ্যৎ অগ্রগতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সমস্যার গভীর বিশ্লেষণ দেখায় যে, দেশের মেধার ক্ষয় তিনটি ক্রিয়াশীল স্তম্ভের-ছাত্র, শিক্ষক এবং রাজনীতি-অসংগত প্রভাবের কারণে। শিক্ষার্থীর উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং চিন্তাশীলতা রাজনৈতিক প্রভাব এবং শিক্ষকবৃন্দের দায়িত্বহীনতার কারণে ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া দেশের গবেষণা, প্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এবং সামাজিক মানসিকতার জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের উচিত রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে থেকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা। তাদের মননশীলতা, স্বাধীন চিন্তাশীলতা এবং সৃজনশীলতা বিকাশে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার মান রক্ষা করা এবং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করা। শিক্ষকরা কেবল পাঠ্যক্রম সম্পন্নকারী নয়, শিক্ষার্থীর অন্তর্দৃষ্টি, নৈতিকতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রহরী হওয়া উচিত। রাজনীতিকে শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দূরে রাখা অপরিহার্য। প্রশাসন এবং সরকারের উচিত স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং শিক্ষার মান রক্ষা নিশ্চিত করা। শিক্ষা, মেধা এবং নৈতিকতার সঠিক সমন্বয় দেশের শক্তি নির্ধারণ করে। শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার অবক্ষয় মানে দেশের ভবিষ্যতের সংকট। শিক্ষার্থীর মননশীলতা, শিক্ষকের নৈতিকতা এবং রাজনীতির স্বাস্থ্যকর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে মেধা পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। ছাত্র, শিক্ষক এবং রাজনীতির মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেশের মেধাকে শূন্যের দিকে ঠেলে দেয়। শিক্ষার্থী নিজের মেধা বিকাশে মনোনিবেশ করবে, শিক্ষক শিক্ষার মান রক্ষা করবে এবং রাজনীতি শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বিরত থাকবে। একমাত্র এই সমন্বিত প্রচেষ্টা দেশের মেধাকে পুনরুজ্জীবিত করবে এবং জাতিকে শক্তিশালী ও সৃজনশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

লেখক: মো: শামীম মিয়া; কলামিস্ট