উত্তরের দিনাজপুর জেলার কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে আছে সুখ্যাতি। ধানের জেলা দিনাজপুরে কৃষিজাত প্রতিটি ফসলের বাম্পার ফলন হয়। কালের চক্রে কাউন, আউষ চাল প্রায় বিলুপ্ত। এছাড়াও পান উৎপাদনেও এ জেলার ছিল সুখ্যাতি। এ সময় এ জেলা থেকে পান ক্রয় করে পাইকারী ব্যবসায়ীরা অন্যান্য জেলায় নিয়ে যেত কিন্তু পান চাষীরা হতাশ হয়ে পড়েছে এবং পাশাপাশি পান চর্চ্চাকারী, দিনমজুর-কর্মচারীরাও বেকার হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে অধিকাংশ উপজেলায় পান চাষ হচ্ছে না। দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় এ বছর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে পানের বাম্পার ফলন হয়েছে। হাকিমপুর উপজেলার খট্টামাধবপাড়া ইউনিয়নের মাধবপাড়া গ্রামের মাঠজুড়ে এখন সবুজে মোড়া পানের বরজ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে পানপাতার সজীব সুবাস। কিন্তু ফলন ভালো হলেও বাজারে আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় চাষিদের মুখে হাসির বদলে নেমে এসেছে হতাশার ছায়া।
বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে পান। বিবাহ, আতিথেয়তা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা সামাজিক আড্ডায় পান অপরিহার্য এক উপাদান। তাই এ ফসলের ভালো ফলনে চাষিরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, হয়তো এবার পরিশ্রমের ফল মিলবে, কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানো যাবে। কিন্তু বাজারে পানপাতার দর পড়ে যাওয়ায় সেই আশা এখন ম্লান হয়ে গেছে।
হাকিমপুর উপজেলার মাধবপাড়া গ্রামের পানচাষি মাইদুল শেখ বলেন, এখন পান বিক্রি করে কোনো লাভ হচ্ছে না, বরং লোকসান দিতে হচ্ছে। সার, কীটনাশক, সেচ আর শ্রমিকের মজুরি, সবকিছুর দাম বেড়েছে। আগে যে পানে ৫০ টাকা পাওয়া যেত, এখন সেটি ২৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে খরচও উঠছে না।
বিরামপুর উপজেলার চাষি আমিনুল জানান, আমাদের পান বেশ ভালো ফলেছে, কিন্তু বাজারে দাম নাই। ১০০ পিস পান এখন ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগের বছর এই দামে অর্ধেক পানও পাওয়া যেত না। খরচ মেটাতে গিয়েই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ফুলবাড়ী উপজেলার তরুণ পানচাষি ইয়াকুব আলী বলেন, পানচাষ আমাদের পৈত্রিক পেশা। এবার ফলন খুব ভালো হয়েছে, কিন্তু বিক্রি না হলে সেই পরিশ্রম বৃথা যায়। বাজারে পাইকাররা ইচ্ছামতো দাম বলে। আমরা বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করি।
এদিকে খানসামা উপজেলার চাষি মেসবাহ বলেন, আমি ২০ বছর ধরে পানচাষ করছি। এমন ফলন অনেক দিন দেখি নাই, কিন্তু পানের দাম হ্রাস পাওয়ায় আমি হতাশ। এই রকম দামের অবস্থা আগে কখনো হয়নি। পান রাখার জায়গা না থাকায় কম দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই।
একই এলাকার নারী পানচাষি শেফালী জানান, পানচাষে নারীরাও সমানভাবে পরিশ্রম করে। বরজে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করি। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা, ঘর চালানোই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
চাষিদের পাশাপাশি পানবাগানের শ্রমিকরাও বিপাকে পড়েছেন। আগে যেখানে প্রতিদিন কাজ পেতেন, এখন অনেক বরজেই কাজ কমে গেছে। ফলে আয়ও আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এ বিষয়ে হাকিমপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরজেনা বেগম বলেন, পানচাষ একটি পরিশ্রমসাপেক্ষ ফসল। কৃষি অফিস থেকে আমরা নিয়মিত মাঠ পর্যায়ে চাষিদের পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি। এবার ফলন সত্যিই ভালো হয়েছে। তবে দামের বিষয়টি বাজারের চাহিদা ও যোগানের ওপর নির্ভর করে। কৃষক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে আমরা সর্বদা সচেষ্ট।
কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে হাকিমপুর উপজেলায় প্রায় ৪০ হেক্টর জমিতে পানচাষ হয়েছে এবং উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫৪০ মেট্রিক টন। এ অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবার বংশ পরম্পরায় পানচাষের সঙ্গে জড়িত এবং অনেকে এটিকেই জীবিকার প্রধান উৎস হিসেবে ধরে রেখেছেন।
ভালো ফলনের মাঝেও যখন চাষির মুখে হাসি নেই, তখন স্পষ্ট হয়। কৃষকের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। পানের মতো ঐতিহ্যবাহী এই ফসলের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন সরকারি সহায়তা, ন্যায্য দাম ও সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা এবং তদারকির প্রয়োজন।