ধীর বাস্তবায়ন ও বড় কাটছাঁট: উন্নয়ন বাজেটে নতুন সংকেত

এফএনএস | প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:১৭ পিএম
ধীর বাস্তবায়ন ও বড় কাটছাঁট: উন্নয়ন বাজেটে নতুন সংকেত

উন্নয়ন বাজেটে পরপর কয়েক বছর বড় কাটছাঁট এখন প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও একই চিত্র-দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মূল এডিপি নেমে আসছে দুই লাখ কোটি টাকায়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, ক্রয়-প্রক্রিয়ার জট, প্রশাসনিক দেরি, বিদেশি সহায়তা ছাড়ে বিলম্বসহ নানা কারণে ৩০ হাজার কোটি টাকার এই কাটছাঁট এবারও দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেই সামনে এনেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় যেসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি কম, সেগুলো থেকে বরাদ্দ কমিয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সমাপ্তির অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নীতিগতভাবে এটি অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়-প্রকল্প বাছাইয়ের পর্যায়ে কি যথেষ্ট যাচাই-বাছাই হয়? যদি হয়, তবে বছর ঘুরে ঘুরে একই ‘ধীরগতির’ কারণ দেখিয়ে কাটছাঁটের প্রয়োজন কেন দেখা দেয়? একটি উদ্বেগজনক দিক হলো বৈদেশিক সহায়তা। মূল এডিপিতে যেখানে ৮৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সহায়তা ধরা হয়েছিল, সংশোধিত বাজেটে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার কোটি। অর্থাৎ বিদেশি অর্থে পরিচালিত প্রকল্পগুলোতে বাস্তবায়নগত দুর্বলতা এবারও প্রকট। ডলার সংকট, প্রকল্প প্রস্তুতির বিলম্ব এবং দরপত্র-পর্যায়েই গড়িমসি এগুলোর অন্যতম কারণ। এতে বৃহৎ অবকাঠামো, জ্বালানি, পরিবহনসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো প্রভাবিত হয়। এডিপির খাতভিত্তিক বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত এখনো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। সড়ক, রেল, মেরিটাইম ও মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পের কারণে এ খাতে বরাদ্দ প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ-জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ণ ও স্বাস্থ্য খাত রয়েছে পরবর্তী অবস্থানে। গুরুত্বপূর্ণ এসব খাতে কাটছাঁট হলে পরিকল্পিত উন্নয়নের গতি ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। এবার ডিসেম্বরের মধ্যেই আরএডিপি চূড়ান্ত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে-এটিও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত। নির্বাচনের বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি যাতে থমকে না যায়, তা নিশ্চিত করাই সরকারের উদ্দেশ্য। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ঠিকই বলেছেন-গত বছরের মতো ধীরগতির অজুহাত এবার চলবে না। কিন্তু মূল প্রশ্ন আরও গভীর-কেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাঠামো এখনো এত দুর্বল? কেন দক্ষ জনবল, স্বচ্ছ ক্রয়-ব্যবস্থা, সমন্বিত মনিটরিং এবং জবাবদিহির ঘাটতি দূর হচ্ছে না? শুধু কাটছাঁট নয়, প্রয়োজন সংস্কার। প্রকল্প নকশা ও অনুমোদন-পর্বে বাস্তবসম্মত সময়সীমা নির্ধারণ, বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনা, বিদেশি সহায়তার দ্রুত ছাড় নিশ্চিতকরণ, এবং কার্যকর মনিটরিং-এগুলো ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়বে না। উন্নয়ন বাজেট কেবল সংখ্যার খেলা নয়-এটি জাতীয় অগ্রযাত্রার দিকনির্দেশনা। তাই বরাদ্দ কমানো বাস্তবতার প্রতিফলন হলেও, এর পুনরাবৃত্তি আমাদের পরিকল্পনা সংস্কৃতির দুর্বলতারই ইঙ্গিত। এখন সময় কাটছাঁটের চক্র ভেঙে বাস্তবায়নে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার। দেশের উন্নয়ন তা ছাড়া এগোবে না।