গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকেই আশা করেছিলেন-গুম, বন্দুকযুদ্ধ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অন্ধকার অধ্যায় শেষ হবে। কিন্তু আলজাজিরার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১৪ মাসেই অন্তত ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন; গড়ে প্রতি মাসে তিনজন। সর্বশেষ প্রান্তিকে সংখ্যাটি আরও বেড়েছে। একসময় যে ভয়াবহতার বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, সেটিই নতুন রূপে ফিরে আসছে কি? প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গুলি করে হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন এবং পিটুনিতে মৃত্যুর মতো গুরুতর অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই আটক ব্যক্তি, এমনকি নিরাপত্তা অভিযানে ধরা পড়া সাধারণ মানুষও রয়েছেন। এই মৃত্যুসমূহের ক্ষেত্রে যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি দৃশ্যমান-তা আগের সরকারের আমলের অভিজ্ঞতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। নজরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, আসিফ সিকদার ও তৌহিদুল ইসলামের মতো ঘটনাগুলো দেখায়, পরিবারগুলোর সামনে বিচার ও সত্যের দরজা এখনও বন্ধ। অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে তদন্ত চলছে, কিন্তু মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ-অনেক ক্ষেত্রেই তদন্তের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অনুপস্থিত। সেনাবাহিনী কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেও সামগ্রিক সংস্কারের কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘের সুপারিশগুলোর প্রতিও সরকারের সাড়া মেলেনি। র্যাব বিলুপ্তি, এনটিএমসি সংস্কার কিংবা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা সীমিত করার মতো পরামর্শ বাস্তবায়ন হয়নি। এর ফলে আগের সরকারের অধীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিরূপণ ও বিচার প্রশ্নে অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহি নিয়ে রাজনৈতিক মতভেদও স্পষ্ট। বিএনপির মতে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার বন্ধ করা কঠিন। বিপরীতে মানবাধিকারকর্মীদের প্রশ্ন-সাংবিধানিক সরকারই হোক বা অন্তর্বর্তী প্রশাসন, মানবাধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব একই। ইতিহাস বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি কোনো একটি দলের আমলের সমস্যা নয়; র্যাবের ক্রসফায়ার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক হেফাজতে মৃত্যু-সবই দায়বদ্ধতার ঘাটতির বহমান ধারার অংশ। তাই সমাধানও সাময়িক হতে পারে না। প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিবর্তন যে মানবাধিকার নিশ্চয়তার মাধ্যমে দৃশ্যমান হবে-এই প্রত্যাশাই ছিল জনগণের। সেই প্রত্যাশা আজ প্রশ্নের মুখে। রাজনৈতিক সরকার ফিরে এলেও, বা বর্তমান প্রশাসন বহাল থাকলেও, প্রকৃত পরিবর্তনের মানদণ্ড হবে একটাই-মানবজীবন রক্ষায় রাষ্ট্রের শূন্য সহনশীলতা ও জবাবদিহিমূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা অতীতের ভুল কাটিয়ে উঠতে পারব কি না, নাকি একই চক্রের পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে।