দেশজুড়ে অপহরণের যে উর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে, তা শুধু উদ্বেগজনকই নয়-জননিরাপত্তা ব্যবস্থার সামগ্রিক ভঙ্গুরতাকেই স্পষ্ট করে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশে অপহরণের মামলা হয়েছে ৯২১টি; গত বছর একই সময় ছিল ৫০১। অর্থাৎ এক বছরে অপহরণের হার প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিদিন গড়ে তিনজন মানুষ অপহৃত হওয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। পুলিশের তথ্য বলছে, বেশির ভাগ অপহরণই ঘটছে মুক্তিপণ আদায়, প্রতিশোধ, প্রেমঘটিত বিরোধ, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবহারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রতারণা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা অপহরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আগে যেখানে বেশির ভাগ ঘটনা রাতের অন্ধকারে ঘটত, এখন তা দিনের বেলাতেও ঘটছে-রাইডশেয়ারিং, অনলাইন বেচাকেনা বা পরিচয়ের ফাঁদকে ব্যবহার করে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, পুলিশ রেকর্ডের যে সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে, বাস্তবে তা আরও বেশি হতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব বা সামাজিক চাপের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। অর্থাৎ ভয় ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি অপহরণকারীদের আরও সাহসী করে তুলেছে। এটি আইনের শাসনে বড় ঘাটতির ইঙ্গিত বহন করে। অক্টোবর মাসের ১১০টি অপহরণ এ সংকটের সর্বশেষ চিত্র। সুদীপ্ত রায়ের মতো শিক্ষার্থীর হত্যা, নওগাঁর ব্যবসায়ী অপহরণ, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী নির্যাতন কিংবা টেকনাফে কলেজছাত্র উদ্ধার-এমন ধারাবাহিক ঘটনাগুলো দেখায়, শহর থেকে মফস্বল-কোথাও নিরাপত্তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। অভিভাবকদের উদ্বেগ বেড়েছে; একা বের হওয়া বা স্কুল-কলেজে যাতায়াত নিয়েও তারা দুশ্চিন্তায়। পুলিশ ও র্যাব বলছে, তারা কঠোর অভিযান ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি জোরদার করেছে; বেশ কিছু চক্র ধরা পড়েছে-এটি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়-অপহরণকারীরা কীভাবে এত সহজে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারছে? কেন অপহরণের সংখ্যা এক বছরে দ্বিগুণ হলো? শুধুই অভিযান দিয়ে কি এই প্রবণতা থামানো সম্ভব? সমাজবিজ্ঞানীরা ঠিকই বলেছেন-অপহরণের মূল কারণ শুধু অপরাধচক্র নয়; বরং পরিবারের ভেতর থেকে শুরু করে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, ডিজিটাল প্রতারণা থেকে আর্থিক চাপ-সব মিলেই একটি জটিল সামাজিক সংকট তৈরি হয়েছে। তাই সমাধানও হতে হবে বহুমাত্রিক। প্রয়োজন কঠোর আইনপ্রয়োগের পাশাপাশি প্রতিটি ঘটনার দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত, পাশাপাশিই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, ডিজিটাল নিরাপত্তা শিক্ষা এবং প্রতিরোধমূলক নজরদারি। অপহরণ কোনো সাধারণ অপরাধ নয়-এটি সরাসরি মানবজীবনকে বিপন্ন করে, সমাজে আতঙ্ক ছড়ায় এবং রাষ্ট্রের ওপর নাগরিক বিশ্বাসকে দুর্বল করে। তাই এ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি নয়-রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং সমাজ-সবার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই অন্ধকার চক্র ভাঙা সম্ভব নয়। দেশের মানুষ নিরাপত্তা চায়, ভয়ের মধ্যে নয়-স্বস্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে বাঁচতে চায়।