প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মের শিক্ষক জরুরি

মো: হায়দার আলী | প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৬:৪০ পিএম
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মের শিক্ষক জরুরি

বলা হয় শিক্ষা জাতীয় মেরুদন্ড আর এখন বলা হচ্ছে সুশিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। কুরআন শিক্ষা ছাড়া জ্ঞান অর্জন অপূর্ণ থেকে যায় এই ধারণার কারণ হলো, ইসলামে কুরআনকে জ্ঞানের সর্বোচ্চ উৎস এবং মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখা হয়। এই মতাদর্শ অনুসারে, জাগতিক জ্ঞানের পাশাপাশি দ্বিনি জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য, কারণ কুরআন সঠিক বিশ্বাস ও জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনা দেয় যা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য জরুরি। অন্ধকার বর্বর যুগ থেকে মানুষকে আলোর পথে ফিরিয়ে এনেছিলো যে ঐশী গ্রন্থ, অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক্বিদিক হারা মানুষকে আলোয় উদ্ভাসিত করে শান্তির বার্তা শুনিয়েছিলো যে গ্রন্থ, সে হলো পবিত্র আল কুরআন। মানবতার মুক্তির দিশারি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ. এর কাছে হযরত জিবরাইল এর মাধ্যমে যে গ্রন্থটি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শিখিয়েছেন হযরত জিবরাইলকে তারপর জিবরাইল শিখিয়েছেন রাসূল সা. কে। রাসূল আবার শিখিয়েছেন তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের। কুরআন শিক্ষার এ ধারা অব্যাহত থেকে সেই সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্ব থেকেই মানুষ তার বুকে ধারণ করে এসেছে পবিত্র এ গ্রন্থের প্রতিটি বাণী। কুরআনের এই ধারাবাহিকতা তথা শিক্ষা করা এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়া সম্পর্কে হাদিসে এসেছে ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম যে কুরআন শিখে এবং অন্যকেও শেখায়।’ কুরআন শেখা এবং শেখানোর সেই পথ ও পদ্ধতি আজও অম্লান এ ধরার বুকে। পৃথিবীর সব মুসলিম দেশগুলোতেই মসজিদ ভিত্তিক কুরআন শিক্ষার আসর আজও চলমান। যার সূচনা স্বয়ং রাসূল সা. করে গিয়েছিলেন। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের এ দেশ বাংলাদেশেও কুরআনের শিক্ষা আজও জীবন্ত ও প্রাণবন্ত, যেমনটি রাসূল সা. এর যুগে ছিলো। একসময় সারা দেশের প্রতিটি মসজিদেই ফজরের নামাজের পরপর ছোট-ছোট সোনামণিদের ভিড় দেখা যেত। কায়দা, আমপারা কিংবা কুরআন বুকে যারা ছুটে আসতো মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে কুরআন শিখবে বলে। বর্তমানে যুগের আধুনিকায়নে যদিও সে চিত্র শহুরে এলাকায় খুব একটা দেখা মিলে না। কমে এসেছে গ্রামগঞ্জেও। শহুরে এলাকাগুলোতে ফজরের পরপরই বিভিন্ন স্কুল কিন্ডারগার্টেন এর কার্যক্রম শুরুর ফলে সোনামণিদের কুরআন শেখার সেই দলবদ্ধ প্রয়াস এখন খুব একটা দেখা যায় না। তার মানে কি কুরআন শিক্ষার সেই নববী কার্যক্রম আজ স্তিমিত হয়ে গিয়েছে? মসজিদের ইমাম সাহেবরা কি তবে এখন ছোট ছোট শিশুদের কুরআন শেখানোর সেই ধারাবাহিকতাকে অবসর জানিয়েছেন? কিংবা শহুরে রাস্তাঘাটে দৃশ্যমান ‘কুরআন পড়াতে চাই’ এরকম দেয়াল লিখনগুলো কি তবে কুরআন শিক্ষার ধারাবাহিকতাকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে.? মফস্বলসহ শহুরে মসজিদগুলোতে মোটেও ছাত্রছাত্রী কমে যায়নি বা কুরআন শিক্ষার সে নববী ধারা বিলুপ্তির পথ বেঁছে নেয়নি বরং এখনো প্রতিটি মসজিদেই কুরআন শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা আসেন। ইয়াতিম খানায় ইয়াতিমদের নিয়মিত কুরআন শিক্ষা দেয়া হয় এদের সংখ্যা কম নেই। আগে হুজুরগন এক বেলা সকালে আসতো এখন নানা স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন চালুর দরুন যে-সব বাচ্চা সকালে যেতে পারে না তাদের জন্য বিকেলেও ব্যবস্থা করা হয়েছে যেটাকে বৈকালিক মক্তব বলে চিনে থাকবেন। শুধু তাই নয় আগে বৃদ্ধদের জন্য কোন মক্তব তেমন ছিলো না অথচ এখন গ্রামে কোন কোন মসজিদে মসজিদে শহরের প্রায় মসজিদগুলোতেই বয়স্ক মাদ্রাসা নামে কুরআন শিক্ষার মক্তব চালু হয়েছে এবং সেগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষেরা তাদের কাজ শেষে কুরআন শিখতে উপস্থিত হচ্ছে। শহরে বিভিন্ন ধরনের লিফলেট প্রচার করে কুরআন শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটাও আমার দৃষ্টিতে একটি ভালো দিকই বটে। কারণ এটাকে বাণিজ্য হিসেবে দেখার কোনই অবকাশ নেই। একটা ছেলে বাড়ি বাড়ি কুরআন শিখিয়ে কত টাকাই বা ইনকাম করে। অথচ তাদের সেই বাসা বাড়িতে গিয়ে কুরআন শেখানোর চেষ্টা আছে বলে হয়ত যে-সব ফ্যামিলির ছেলে মেয়েরা মসজিদের মক্তবে আসতে পারছে না তারা ঘরে বসেই কুরআন শিখতে পারছে। তাছাড়া দেশে এখন মাদ্রাসা বেড়েছে বহুগুণ। সেগুলোতে ছাত্ররা কুরআনের হাফেজ হচ্ছে এবং সারা বিশ্বে বাংলাদেশের হাফেজদের সমাদর রয়েছে। তারা একের পর এক শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষর রেখে চলেছে কুরআন শিক্ষার প্রতিযোগিতায়। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে কুরআনের সেই নববী প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত রয়েছে। যদিও সময় ও যুগের আধুনিকায়নের ফলে শেখা ও শেখানোর কৌশলে এসেছে পরিবর্তন। মানুষের শিক্ষার একমাত্র স্থান ছিলো স্কুল কলেজ। দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে যারা শিক্ষালয়ে এসে বিদ্যার্জন করেছিল তাদের সন্তানরাই আজ বাসায় টিউটর রেখে কোচিং বা প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। এটা দোষের কিছু নয় বরং শিক্ষা ব্যবস্থায় অভাবনীয় পরিবর্তন ও সহজীকরণ বলা যায়। শহরের প্রায় প্রতিটি মসজিদেই তো মক্তব আছে। হয় বিকেলে না হয় সকালে বা সন্ধ্যার পর। হয়ত শহর এলাকা বলে দলবেঁধে শিশুদের কুরআন বুকে মক্তবে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায় না তাই বলে যে কুরআনের শিক্ষা চলছে না একথা ভাববার সুযোগ নেই। সত্যিই আপাতদৃষ্টিতে কুরআনের সেই মক্তব ভিত্তিক কার্যক্রম নেই মনে হলেও কুরআন চর্চা থেমে নেই। হয়ত পদ্ধতিগুলো পরিবর্তন হচ্ছে বা হবে। যে চর্চার ফসল হাফেজ নাজমুস সাকিব ও হাফেজ তরিকুল ইসলামের মতো বিশ্বজয়ী হাফেজরা। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এভাবেই তাঁর ঐশী বাণিকে সংরক্ষণ করে নিচ্ছেন যুগের পর যুগ। দেশের সকল সরকারি, এমপিও ভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্মের সহকারী শিক্ষক পদসহ কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দু ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্মের শিক্ষক থাকলেও অত্যন্ত দুঃখজনক হলে বাস্তব সত্য দেশের প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয় গুলিতে ধর্মীয় শিক্ষক পদ নেই। ফলে ইসলাম শিক্ষা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোটি কোটি শিক্ষার্থী সঠিক কুরআন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইসলামি না থাকায় বুঝে না বুঝে নানা অপরাধে জড়িয়ে ধ্বংস হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন। বিভিন্ন সময়ে আলেম ওলেমাগণ, সচেতন মহল এ সব বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে মিটিং, মিছিলসহ বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করা হলেও তা বাস্তবে এর কোন প্রতিফল আজও ঘটেনি ফলে দেশের বিরাট একটা অংশ কুরআন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় জ্ঞানার্জন, ইসলামি আইনশাস্ত্র ও নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মাদ্রাসা শিক্ষা শুধু ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কাঠামোর একটি অন্যতম ধারা হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৩৫ হাজারের বেশি মাদ্রাসা আছে, যেখানে ৬০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এত বড়ো একটি জনগোষ্ঠী যখন একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাধারায় যুক্ত, তখন এর কাঠামোগত সমস্যা, আধুনিকীকরণের অভাব ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা জাতীয় উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বড়ো সংকট তৈরি করে। বাংলাদেশে মূলত দুটি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান। 

আলিয়া মাদ্রাসা ব্যবস্থা: এটি মূলত সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন ও আধুনিক কারিকুলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করে। 

কওমি মাদ্রাসা ব্যবস্থা: মূলত বেসরকারিভাবে পরিচালিত, ঐতিহ্যগত ইসলামি শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। এখানে ধর্মীয় বিষয় যেমন, কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি ভাষা প্রধান। কওমি শিক্ষা রাষ্ট্রীয় কারিকুলাম অনুসরণ করে না। ২০১৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের ধাঁচে ‘দাওরায়ে হাদিস’ মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি পায় (শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ২০১৮)। 

মাদ্রাসা শিক্ষার বর্তমান অবস্থা-

শিক্ষার্থী সংখ্যা: প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ শিক্ষার্থী মাদ্রাসা শিক্ষায় যুক্ত। প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা: সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৫ হাজারের বেশি মাদ্রাসা। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে শিক্ষা ও খাবার-আবাসনের সুবিধা থাকায় মাদ্রাসার প্রতি ঝোঁক বেশি। উচ্চশিক্ষার বাজারে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কিছুটা জায়গা করে নিতে পারলেও কওমি ধারার শিক্ষার্থীরা আধুনিক চাকরির বাজারে প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কওমি ধারার মাদ্রাসাগুলোতে এখনো সেকেলে পাঠ্যসূচি চালু আছে। গণিত, বিজ্ঞান, কম্পিউটার, অর্থনীতি, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয় খুব সীমিত বা একেবারেই নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিশ্বে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। কওমি মাদ্রাসাগুলি স্থানীয় অনুদান ও দানের ওপর নির্ভরশীল। সরকারি অর্থায়ন সীমিত থাকায় অবকাঠামো দুর্বল ও শিক্ষার মান খারাপ। 

সামাজিক ধারণা ও বৈষম্য: অনেকের কাছে মাদ্রাসা শিক্ষা ‘অপ্রয়োজনীয়’ বা ‘চাকরির বাজারে অযোগ্য’ শিক্ষার সমার্থক হয়ে গেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ক্ষুণ্ন করে এবং সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। প্রাথমিক বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে ইসলাম শিক্ষার শিক্ষকের পদ দ্রুত সৃষ্টি করা অপরদিকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধ করা প্রয়োজন। যেন শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে যুগোপযোগী আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান অর্জনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। 

লেখক: মো: হায়দার আলী; সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট