মহান রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০৮ তম ও বাসদ (মার্কসবাদী)-এর ৪৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) শাহবাগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে জনসভা শুরুর পূর্বে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি শাহবাগ থেকে কাটাবন সায়েন্সল্যাব মোড় ঘুরে জনসভা স্থলে এসে শেষ হয়। জনসভায় সারাদেশের দলের কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেন। বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানার সভাপতিত্বে এবং সদস্য জয়দীপ ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সদস্য কমরেড শফিউদ্দিন কবীর আবিদ এবং কমরেড সীমা দত্ত। জনসভায় কমরেড মাসুদ রানা এবং বক্তারা বলেন- "১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর বিশ্বের বুকে প্রথম শোষণ-বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। রুশ বিপ্লব এতদিনকার বৈষম্যহীন সমাজের ইউটোপিয়ান ধারণাকে বাস্তবে প্রমাণ করেছিল মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে। এ বিপ্লব এই শিক্ষা তুলে ধরল যে, জনতার সংঘবদ্ধ শক্তির চেয়ে বড় কিছু নেই। বৈষম্য বাস্তবে কীভাবে দূর হয়- তার পথ দেখালো রুশ বিপ্লব। রুশদেশ দেখালো চাষাভুষা, নিরক্ষর শ্রমিকরা সংগঠিত হলে বিপ্লব করতে পারে। রুশ বিপ্লবের সফল রূপকার লেনিন ও পরবর্তীতে মহামতি স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রুশ দেশ ঘোষণা করে তাদের দেশে আর ভিক্ষুক নেই, বেকার নাই। রুশদেশ ঘুরে এসে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন আপ্লুত হয়ে বই লিখেছেন, 'যে দেশে মানুষ বড়।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, "..বহুদূরব্যাপী একটা ক্ষেত্র নিয়ে এরা একটা নূতন জগৎ গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে লেগে গেছে। ... যত শীঘ্র পারে এদের খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে, হাতে হাতে প্রমাণ করে দিতে হবে- এরা যেটা চাচ্ছে সেটা ভুল নয়, ফাঁকি নয়। হাজার বছরের বিরুদ্ধে দশ-পনেরো বছর জিতবে বলে পণ করেছে।" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে দেশে দেশে যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলন জোরদার হয়। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো চাইলেই যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে না এমন পরিবেশ তৈরি হয়। অথচ আজ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বে যুদ্ধ উন্মাদনা, যুদ্ধ লাগিয়ে রাখছে। ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার ন্যায়সঙ্গত দাবিকে উপেক্ষা করে জায়নবাদী ইসরায়েলকে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গত জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হলো। বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ. আন্দোলনে বিগত সরকারের ফ্যাসিবাদী কায়দায় শাসনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ, মূল্যস্ফীতি, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে এদেশের জনগণ রাজপথে নেমেছে। অসংখ্য ছাত্র-জনতা বীরত্বের সাথে জীবন দিয়েছে ফ্যাসিবাদী জুলুমের বিরুদ্ধে। প্রত্যাশা ছিল সুন্দর আগামীর। দেশের নানামুখী গণতান্ত্রিক সংস্কারের স্বাভাবিক প্রত্যাশা অভ্যূত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে পুরণ তো হয়নি উল্টো বিভিন্ন মত-পথের মানুষ জীবনের ঝুঁকিসহ নানা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। মব তৈরি করে নারীকে আক্রমণ, মাজার ভাঙা, বাউলদের উপর আক্রমণ কোনটাই অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ঠেকাতে পারেননি। এই সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। সম্প্রতি ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৬ টাকা বাড়ানো হলো। অতীতের ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের মতোই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছে এ সরকার। সাধারণ জনগণের উপর ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়লো। অভ্যুত্থান, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকরা যখন বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেছে সেখানে আন্দোলন দমনে সরকার পেট্রোয়া পুলিশ বাহিনী দিয়ে শ্রমিক হত্যা করেছে। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শ্রমজীবী জনতার জীবনদান সবচেয়ে বেশি। সরকার বিদেশি কোম্পানিকে দেশের সমুদ্র বন্দর ইজারা দেয়ার জন্য মরিয়া। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বশ্যতা আমরা অস্বীকার করেছিলাম। সর্বশেষ ঐক্যমত কমিশন রচিত জুলাই সনদ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারলো না। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে রাষ্ট্র সংস্কারের যে দাবিটি উঠেছে, এর মূল নির্যাস ছিল এই যে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে, নির্বাচনব্যবস্থাকে যেভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা ও সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর যে একচ্ছত্র ক্ষমতা সেটাকে কমিয়ে একটা ভারসাম্যে নিয়ে আসা। সংবিধানের মূলনীতির আলোচনাটি এই উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। আদর্শিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে আলোচনার বাইরে রাখা উচিত। কারণ এ ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে। ঐকমত্য সম্ভব নয়। সনদে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন দলের 'নোট অব ডিসেন্ট' থাকলেও অঙ্গীকারনামায় সেটি উল্লেখ করা হয়নি। জাতি গঠনের ইতিহাসও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সনদে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সাংবিধানিক নানা সংস্কারের কথা বলা হলেও এগুলোর বাস্তবায়ন কিভাবে হবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এছাড়া নারীর রাজনৈতিক অধিকার, শ্রমজীবী জনগণের আশু প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ মতামত যেগুলো নারী সংস্কার কমিশন ও শ্রম সংস্কার কমিশন দিয়েছিল তা উপেক্ষিত হয়েছে। সরকার পাল্টানোর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হয় না। যে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামো বিদ্যমান তাকে না পাল্টাতে পারলে ফ্যাসিবাদ হটানো যাবে না। ইতিহাস এই শিক্ষা আমাদের সামনে রেখে গেছে। ফলে দেশের আপামর জনগণের প্রতি আমাদের আহ্বান- ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি দাবি নিয়ে সংগঠিত হোন, গণআন্দোলন গড়ে তুলুন, শ্রমিক শ্রেণির যথার্থ বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে এই বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা বদলের সংগ্রামকে বেগবান করুন।'