দোহাজারী হতে কক্সবাজার ডুয়েল গেজ রেল প্রকল্পে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ও মালামাল ব্যবহার এবং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ৫০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির অভিযোগে দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করেছে। দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে ১৯ আগস্ট ও ২০ অক্টোবর জারি করা দুটি পৃথক পত্রের ভিত্তিতে সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মালেককে টিম লিডার এবং উপসহকারী পরিচালক আনিসুর রহমানকে সদস্য করে দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে প্রকল্পের দরপত্র বিজ্ঞপ্তি, চুক্তিপত্র, কমিটির প্রতিবেদন, মূল্য তালিকা, পেমেন্ট রেকর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সব নথি সাত কার্যদিবসের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে।এই অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে চট্টগ্রাম বিভাগের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী (ডিএসটিই) মো. সেলিমের নাম। অভিযোগে বলা হয়েছে-একই প্রকল্পে তিনি একযোগে চারটি লাভজনক পদে দায়িত্ব পালন করে ব্যাপক প্রভাব খাটিয়েছেন। তাকে বদলির নির্দেশ দেওয়া হলেও তিনি যোগদান না করে প্রভাব খাটিয়ে আগের দায়িত্বেই বহাল থাকেন। স্থানীয় সূত্রের দাবি, তিনি সপ্তাহে দুই-তিন দিন স্বল্প সময়ের জন্য অফিস করেন এবং মূলত টেন্ডার-সংক্রান্ত ফাইলে স্বাক্ষর দিতেই উপস্থিত হন।অনুসন্ধান সূত্র জানায়, প্রকল্পের নয়টি স্টেশনের সংকেত ও টেলিকম ব্যবস্থায় গুরুতর অনিয়ম পাওয়া গেছে। বিদেশ থেকে আনার কথা থাকলেও রডিং স্থানীয়ভাবে নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা ইতোমধ্যেই মরিচা ধরে নষ্ট হওয়ার পথে। চুক্তি অনুযায়ী শিল্পকারখানার মানের এয়ারকন্ডিশনার দেওয়ার কথা থাকলেও বসানো হয়েছে সাধারণ গৃহস্থালি এসি-ফলে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি অতিরিক্ত গরম হয়ে বিকল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। নয়টি স্টেশনের মোট ১৮টি মেকানিক্যাল পয়েন্ট নিম্নমানের লোকাল যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হওয়ায় সিগন্যালিং সমস্যার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমনকি ব্লক কমিউনিকেশনের জন্য আবশ্যক এক্সেল কাউন্টারও স্থাপন করা হয়নি, যা রেল চলাচলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে। সিগন্যাল লাইটে ব্যবহৃত এলইডিগুলো এতটাই নিম্নমানের যে চালকরা সঠিকভাবে নির্দেশনা বোঝা নিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী কপার রড ব্যবহারের কথা থাকলেও আয়রন রডে কপার রঙ লাগিয়ে তা ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া গেছে।রিসেটেলমেন্ট শাখায় জমির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেশি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা অপচয়ের অভিযোগও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। মো. সেলিমের নামে-বেনামে চট্টগ্রামের খুলশী ও কাজির দেউরিতে ফ্ল্যাট এবং ঢাকার বসুন্ধরায় ছয় কাঠা জমিসহ বিপুল সম্পত্তির তথ্যও দুদক খতিয়ে দেখছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে।দুদক ইতোমধ্যে রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে মো. সেলিমের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, স্থায়ী-বর্তমান ঠিকানা, মোবাইল নম্বরসহ সব ব্যক্তিগত তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্র, নোটশিট, চুক্তিপত্র ও মূল্যতালিকাসহ সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। রেল ভবন থেকেও পূর্বাঞ্চলীয় জিএমকে এসব তথ্য সরবরাহের জন্য আলাদা নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, অনুসন্ধানকে প্রভাবিত করতে মো. সেলিম ঢাকায় লবিস্টদের মাধ্যমে বড় অংকের টাকা ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করছেন। প্রায় ১৫ বছর একই অঞ্চলে থেকে গুরুত্বপূর্ণ নানা পদে দায়িত্ব পালন করা একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ কেবল রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার নয়, বরং রেল যাত্রীদের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বলে মনে করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।দুদকের অনুসন্ধান শেষ হলে এই প্রকল্পে দীর্ঘদিনের অনিয়মের চিত্র এবং মূল দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এখন সেই অপেক্ষায় রেলপথ সংশ্লিষ্ট সবাই। দুদকের অনুসন্ধান টিমের টিম লিডার সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, “সঠিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এর মাধ্যমে তদন্ত রিপোর্ট উপস্থাপন করা হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না।” তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধান পুরোপুরি নিরপেক্ষ ও প্রমাণভিত্তিকভাবে করা হবে এবং আপনারা মিডিয়া কর্মীরা তথ্য উপাত্ত দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করুন।