তাজরীন ট্রাজেডির ১৩ বছরেও ক্ষতিপূরণ–পুনর্বাসন হয়নি, শ্রমিকদের বুক ভরা আক্ষেপ

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর, ২০২৫, ১১:২৫ এএম
তাজরীন ট্রাজেডির ১৩ বছরেও ক্ষতিপূরণ–পুনর্বাসন হয়নি, শ্রমিকদের বুক ভরা আক্ষেপ

তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও স্বস্তির মুখ দেখেননি বেঁচে ফেরা শ্রমিকরা। শরীরের ক্ষতচিহ্ন আর মানসিক আতঙ্ক বয়ে বেড়াতে হচ্ছে প্রতিদিন। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে সেই পরিত্যক্ত ভবনের সামনে আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) সকালে জড়ো হয়েছিলেন নিহতদের স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তাদের দাবি একই, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং দোষীদের বিচার।

সকাল থেকেই কেউ ক্র্যাচে ভর দিয়ে, কেউ পরিবার নিয়ে আসেন সেই ভবনের সামনে। আগুনে পোড়া দেয়াল, বাঁকানো জানালার গরাদ দেখলেই যেন ফিরে আসে সেদিনের আতঙ্ক। অনেকের চোখে তখনও ভাসে সহকর্মীদের আর্তচিৎকার, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর অন্ধকারে দৌড়ানোর অসহায় মুহূর্তগুলো।

২০১২ সালের এই দিনে সন্ধ্যার পর ভবনের নিচতলা থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো কারখানাজুড়ে। সরকারি হিসাবে ১১৪ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে, আহত হন দুই শতাধিক। কেউ লাফিয়ে বাঁচলেও আজও তাদের শরীরে রয়েছে সেই দিনের আঘাতের ভার।

আহত শ্রমিক জরিনার স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে ভয়াবহ রাতটি। তিনি জানান, ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠার পর নিচে নেমে আগুন দেখতে পান। চারদিকে দৌড়াদৌড়ি, কান্নার শব্দ আর কালো ধোঁয়ায় অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন সবাই। জানালা ভেঙে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচালেও ভেঙে যায় তার পেছনের হাড়। কাজ করতে পারেন না, সংসার চলে অসুস্থ স্বামীকে ভর করে। তার দাবি, অন্তত শেষ বয়সে একটু পুনর্বাসন।

হাসান মিয়া, মুক্তা বানু, নাসিমা—অনেকের গল্পই প্রায় একই। আহত শরীর নিয়ে কাজ করতে পারেন না, ভরসা চলে গেছে আগের জীবিকার ওপর। সামান্য সহায়তা পেলেও পুনর্বাসন নেই, নেই উপযুক্ত চিকিৎসা।

স্থানীয় বাসিন্দারা আজও ভুলতে পারেন না সেদিনের ভয়াল রাত। কামরুল হাসান বলেন, আগুনের তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশেও। “মানুষ বাঁচার জন্য ছুটছিল, লাফিয়ে পড়ছিল। এত বড় দুর্ঘটনা জীবনে দেখিনি।”

দীর্ঘদিনের আক্ষেপ নিয়ে কথা বলেন তিনতলার অপারেটর সবিতা রানি। আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেও তখন থেকেই তার স্বাভাবিক জীবন থমকে গেছে। জানান, “চিকিৎসা শেষে কাজে ফিরতে চেয়েছিলাম, পারিনি। ক্ষতিপূরণ পাইনি, কাজ পাইনি, শুধু কষ্টই রয়ে গেছে।”

এই ১৩ বছরে বিচারও এগোয়নি উল্লেখযোগ্যভাবে। শ্রমিকনেতারা বলেন, অভিযোগপত্র জমা হলেও মালিকপক্ষ দায় এড়িয়েছে। দোষীদের শাস্তি হয়নি, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও হয়নি।

সবুজ বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ঠান্ডু বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিটির সভাপতি ফরিদুল ইসলাম দাবি জানান, পরিত্যক্ত ভবনটি অধিগ্রহণ করে শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের।

শ্রমিকনেতা খায়রুল মামুন মিন্টুর ভাষায়, “তাজরীনে নিহত ও আহতদের কেউই ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাননি। সরকারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে।”

অরবিন্দু বেপারী বলেন, “এটি শুধু দুর্ঘটনা নয়। শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও দোষীরা শাস্তি পায়নি। সরকার তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করুক।”

স্মৃতির ভার, অব্যবস্থাপনা আর অনিশ্চয়তার চাপে ক্লান্ত আহত শ্রমিকরা তাই আজও একই দাবি করেন, ক্ষতিপূরণ চাই, চিকিৎসা চাই, দোষীদের বিচার চাই। ভয়াল অগ্নিকাণ্ডের ১৩ বছর পরও তাদের জীবনে আলো ফেরেনি, শুধু রয়ে গেছে আগুনের দগদগে ক্ষতচিহ্ন।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে