মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সাধারণত একটি সামাজিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ এটি ব্যক্তির নিজেদের চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এটি সমাজে তথ্যের প্রবাহ এবং নারী-পুরুষ সকলের মধ্যে আলোচনার সুযোগ তৈরি করে। এই অধিকারটি মানুষের সামাজিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ এটি মুক্ত আলোচনা এবং মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে সামাজিক অবকাঠামোকে শক্তিশালী করে। মানুষের অন্তর্নিহিত চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে বাইরে আনার প্রক্রিয়া, যা সাধারণত ভাষার মাধ্যমে ঘটে। মৌখিক, লিখিত বা অন্য যেকোনো সৃজনশীল মাধ্যমেও প্রকাশ হয়। মতপ্রকাশের মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্র-সমাজে নিজের অংশীদারিত্ব, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে মতামত প্রদান করে এবং সমাধান ও পরিবর্তনের জন্য সংলাপ গড়ে তোলে। যখন মতপ্রকাশ স্বাধীন এবং নিরাপদ থাকে, তখনই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি জনগণের অংশগ্রহণ, অন্তর্ভুক্তি, আইনশৃঙ্খলা ও ন্যায়ের শাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে। মতপ্রকাশ ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। যা করতে চাই, যা বলতে চাই- সবকিছুর মাধ্যমই হলো ভাষা। এই ভাষা প্রকাশ করেই আমরা কাজ করি, বুঝি, চিনি, জানি ও অনুভব করি। এটি আমাদের অস্তিত্বের মৌলিক উপাদান। তাই মতপ্রকাশই হলো সেই অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। এটা খর্ব হলে কেবল ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নষ্ট করা নয়, বরং আমাদের সৃষ্টিশীলতা, অগ্রগতি, সমগ্র সমাজের সমৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে। স্বৈরশাসকদের শাসনে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। মানুষের ‘ফ্রিডম অফ স্পীচ’ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের শাসনামলে ‘গণে’র ইচ্ছা নয়, শাসকের ইচ্ছাই শেষ কথা। কেউ এর ব্যতিক্রম করলেই, তার আর রক্ষা নেই। তাকে শায়েস্তা করার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়। ইতিহাস হচ্ছে, এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। একটা সময় গণইচ্ছার কাছেই স্বৈর শাসক পরাভূত হয়। আমাদের দেশে এর একাধিক নজির রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড গর্ভনেন্স ইন্ডিকেটরস’ প্রজেক্টের আওতায় কয়েক বছর আগে বিশ্বের ২০০ দেশের উপর করা জরিপে দেখা গেছে, যেসব দেশে বাকস্বাধীনতা এবং জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া রয়েছে, সেসব দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র সংহত হয়েছে। বাক স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র কেবল নামমাত্র কাঠামো হয়ে যায়। লেখার স্বাধীনতা ব্যতীত মানুষের জ্ঞান, ইতিহাস ও মতামত বিকশিত হয় না। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা না থাকলে সমাজে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। চিন্তা, বিবেক ও বিশ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতার মুক্তি ব্যতীত সমাজে মানসিক স্বাধীনতা ও সহনশীলতা সীমিত হয়ে পড়ে। তথ্য পাওয়ার ও তথ্য প্রচারের স্বাধীনতা অভাব থাকলে সমাজে গুজব ও বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পায়। তাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সব ধরনকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে।