সেচের পানি নিয়ে বিপাকে কৃষক, উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে ইরি আবাদ

মো: হায়দার আলী | প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:২৯ পিএম
সেচের পানি নিয়ে বিপাকে কৃষক, উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে ইরি আবাদ
মো: হায়দার আলী

কী নিয়ে লিখবো ভাবছিলাম, যেন ঠিক করতে পারছিলাম না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদরে একটি মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায়ের পর গেলাম চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার রাম চন্দ্রপুরহাট, সেখানে হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে বসেছিলাম এমন সময় এক কৃষক বললেন, এবারও ডিপ টিউবল গুলিতে সেচের ব্যাপারে বিধিনিষেধ দিয়েছেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ইচ্ছামতো ইরি, গম, ভূট্টা চাষ করা যাবে না। প্রতিটি ডিপটিউলে নয় শত ঘণ্টা, ৫০ বিঘা জমিতে ইরি ধান করতে পারবেন। এর কারণ কি? কেন এ বিধিনিষেধ? তাই এ বিষয়ে লিখার চিন্তা ভাবনা করে আল্লাহর নাম নিয়ে লিখা শুরু করলাম। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রধানতম খাদ্যশস্য ধান। দেশে মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫% ধান চাষ হয়। সেচনির্ভর রবি মৌসুমে বোরোতে মোট ধানের প্রায় ৫৫-৬০% উৎপাদিত হয়। বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রযুক্তির আধুনিক কলাকৌশল উন্নয়ন অনস্বীকার্য। ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপকরণ তিনটি-উন্নতজাতের বীজ, সার ও সেচ। সেচ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ কমানোর মুখ্য ভূমিকা পালন করে। রবি মৌসুমে বোরো উৎপাদনে সেচ ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৩০-৩৫% অর্থ ব্যয় হয়। সেচ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন ও প্রয়োগ। সেচের পানি পরিবহন ও প্রয়োগ যথাযথভাবে নিশ্চিত হলে খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বর্তমানে দেশে কাঁচা সেচনালায় সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে উন্মুক্ত ডিসচার্জ বক্স এবং কাঁচা সেচনালায় অনুস্রাবণ, চোয়ানো, ইঁদুর/পোকামাকড়ের গর্ত, আগাছা ও বাষ্পীয়ভবনে প্রায় ৪০-৫০% পানির অপচয় হয় (বারি বুকলেট-১৯৯৭)। কাঁচা সেচনালায় সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়ার ২-৪% জমিও অপচয় হয়। সেচের পানি উৎস হলো-ক) ভূপরিস্থ ও খ) ভূগর্ভস্থ। সারাদেশে সেচ মৌসুমে সেচকাজে উত্তোলিত পানির পরিমাণ প্রায় ৫৫ বিসিএম (বিলিয়ন কিউবিক মিটার)। তন্মধ্যে শুধুমাত্র ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলিত প্রায় ৭২%, যার পরিমাণ প্রায় ৪০ বিসিএম। তাই আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির বারিড পাইপে সেচের পানির অপচয় ১% নিচে এবং জমির অপচয় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়া বৃদ্ধি এবং জমি ও পরিবহন অপচয়বিহীন স্বল্প সময়ে সহজে সুষ্ঠুভাবে সেচসুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে মাটির নির্দিষ্ট গভীরতায় পাইপ লাইনের যে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয় তাকে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি বলা হয়। বর্তমানে আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড ও আন-প্লাস্টিসাইজড পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড এবং হাই-ডেনসিটি পলি ইথিলিন পাইপের মাধ্যমে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি স্থাপিত হচ্ছে। যার স্থায়িত্বকাল প্রায় ৪০-৫০ বছরেরও অধিক। ফলে মেরামতের প্রয়োজন হয় না এবং যে-কোনো মৌসুমে সেচ প্রদান করা সম্ভব। আবার যে সকল এলাকা বারিড পাইপে পানি পরিবহনে অসুবিধা সময়মতো সেচ প্রদান করা সম্ভব হয় না, সে সকল এলাকায় ফিতা/হাজ পাইপ খুবই উপযোগী ও কার্যকরী পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পানি প্রবাহের মাধ্যমে সেচ পানির অপরিকল্পিত ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খালি হচ্ছে তা কিন্তু নয়, এর সঙ্গে দূষণের বরড়া একটি সম্পর্কও রয়েছে। পানি দূষণের হার ও কারণ যখন দুটোই বেড়েছে, তখন পানি নিয়ে ভাবনা কিন্তু আমাদের বাড়াতেই হবে। সেচ কাজে পানির ব্যবহার আমাদের দেশে প্রচুর। আমাদের দেশের চারপাশে নদী থাকায় পানির পর্যাপ্ততা ও পানির স্বাদ দুই-ই খুব বেশি। কিন্তু শুকনো মৌসুমে পানির চাহিদা পূরণের মাধ্যম একটিই; আর তা হলো ভূগর্ভস্থ পানি। প্রযুক্তির কারণে পানি না পেলেই আমরা আরো গভীর নলকূপ বসাই। এক সময় পানি পাওয়ার জন্য হাজার হাজার ফুট নিচেও আমরা পানির নলকূপ বসাতে দ্বিধা করি না। এবং যাচ্ছেতাইভাবে পানি তুলে ফেলে দেই। সেচের ব্যাপারেও এমনটা হচ্ছে। পানি ব্যবহার বা তোলার জন্য তেমন কোনো টার্গেট নেই। কোন ফসলের জন্য কী পরিমাণ পানি লাগবে তার একটি সঠিক হিসাব জানা থাকা প্রয়োজন। একটি সেচ পাম্প দিনের মধ্যে যত ইচ্ছে পানি তুলবে এটা নিয়ম হতে পারে না। অনেক সময় সেচের জন্য পাম্প থেকে জমি পর্যন্ত মাটির ড্রেন ব্যবহার করা হয়; এর ফলে ড্রেনেই অনেক পানির অপচয় হয়ে যায়। পাইপিং সিস্টেম চালু না করা গেলে এই অপচয় রোধ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে পানি নিয়ে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। বরেন্দ্রভূমিসহ সারা দেশেই পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ হলো পানি আর এক ভাগ স্থল। কিন্তু এ সিংহভাগ পরিমাণ পানি থাকা সত্ত্বেও সব সময় এগুলো দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার উপযোগী হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি মানুষ পান করার জন্য, গবাদিপশু তৃষ্ণা নিবারণ ও ফসল উৎপাদনে সেচ কাজে এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে থাকে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সাপ্তাহিক নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে ১ লাখ ৭০ হাজারটি কূপ থেকে লাখ লাখ লিটার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের জন্য উঠানো হচ্ছে। যার ফলে অনেক স্থানে দ্রুত কমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির মজুত। গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৬৯৩টি জলাভূমিতে পানির স্তরের ৭১ শতাংশই হ্রাস পেয়েছে। যার মধ্যে ৬১৭টিতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বছরে ০.১ মিটারের বেশি করে কমছে। গবেষকরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার করছে। এতে বিশ্বব্যাপী ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমছে এবং এই পানির স্তর কমে যাওয়ায় জনজীবনে এর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তারা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির হ্রাস মানুষের খাওয়ার জন্য পানীয় বা ফসল উৎপাদনে সেচের জন্য কঠিন করে তুলতে পারে এবং ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়ার কারণে বিশ্বে ভূমি ধসের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তারই নমুনা হিসেবে ২১ নভেম্বর শুক্রবার রাজধানী ঢাকা দেশে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ওইদিন সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের দিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এর কেন্দ্রস্থল ছিল নরসিংদীর মাধব মাঝারি মানের ওই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত সারাদেশে ১০ জনের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে মাথায় ইট খসে পড়ে ও আতঙ্কে ভবন থেকে লাফিয়ে সারাদেশে অন্তত ৪ শতাধিক মানুষ আহত শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, ভূমিকম্পের মাত্রা ৪ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল নরসিংদী থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে। এর উৎপত্তি ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। তবে ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭। এর আগে শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটেও দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। মৃদু ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও ছিল নরসিংদীর পলাশে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। পানির স্তর নিচে নামার বিপদ থেকে নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশও মুক্ত নয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নামছে নিচের দিকে। ওয়াসা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে পানি উত্তোলনে বাধ্য হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীর নদীগুলোর পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে পড়ায় তা পরিশোধন করে ব্যবহার করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর যে বাড়তি চাপ পড়ছে, তা অশনিসংকেত বলে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক সংস্থা বেশকিছু উদ্বেগজনক পূর্বাভাস দিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের পানীয়কে আর্সেনিকমুক্ত করার জন্য মৌলিক ও জরুরি পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় সহায়তার জন্য অধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আর্সেনিকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। ভূ-উপরিস্থ জলাধারে ময়লা-আবর্জনা ও রাসায়নিক ক্ষতিকর পদার্থ ফেলা বন্ধের মাধ্যমে দূষণ রোধ করে এর পানি পানযোগ্য করার উপর জোর দিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার কারণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে দিনাজপুর হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল শারীরতত্ত্ব ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শ্রীপতি সিকদার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তর আছে, সেটি নিচে নেমে যাচ্ছে। কারণ ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। যেখান থেকে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয়, তখন সে জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। আবার যখন ওপর থেকে পানি পড়ে, অর্থাৎ বৃষ্টির পানিতে ফাঁকা জায়গাটা পূরণ হয়ে যায়। এ ব্যবস্থায় যদি অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, অর্থাৎ বেশি পানি তোলা হয় আর কম পানি জমা হয়, সে ক্ষেত্রে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। একটা সময় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এত পরিমাণে ছিল না। সেচকাজের জন্য পানি পাওয়া যেত খাল-বিল আর নদী-নালা থেকে। এখন তা পাওয়া যায় না। কৃষিকাজ বেড়েছে। সেচ ছাড়া কৃষি চিন্তাই করা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিও হয়েছে অনিয়মিত। গাছপালা কমেছে, তাপমাত্রা বেড়েছে। সব ঠিকঠাকমতো না হওয়ায় পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা জরুরি। কৃষিকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়িয়ে শুধু পানীয় পানি ভূগর্ভ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয়গুলো দখল নয়, বরং সংস্কার করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। রবি মৌসুমে কৃষিতে শতভাগ সেচ প্রয়োজন হয়। বোরো মৌসুমেও ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহার হয়। সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমন ও আউশ মৌসুমে ধানের আবাদটা বৃদ্ধি করা যেত। কারণ, সে সময় বৃষ্টি থাকে। এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের বিষয়ে আইনের বাধ্যবাধকতা জরুরি। গবেষণা বলছে, এখন থেকে ৫০ বছর আগেও ৪০-৫০ ফুট গভীরতায় পানি পাওয়া যেত। এখন ১৫০-১৬০ ফুট গভীরতায় পানি মিলছে। ১০ বছর পর হয়ত ২০০ ফুট গভীরতায়ও পানি পাওয়া যাবে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। ভূমিধস দেখা দেবে। উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমতল এলাকায়ও প্রভাব পড়বে। উপকূলীয় অঞ্চলে ভূগর্ভে নোনাপানি ঢ়ুকছে। সেই পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সে পানিতে ভারী ধাতুর উপক্রম দেখা দেবে। এতে ফসল, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। কারণ, সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লবণপানি শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ ভীষণভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। প্রতি বছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী পানি সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সকলের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ কার্যক্রমকে বেগবান করা। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীবন-জীবিকা আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা দখল, ভরাট ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিশ্বাস ফেলছে। যে পানির অপর নাম ছিল জীবন আজ সেই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার পানির ওপর নাম বিষ হিসাবে পরিলক্ষিত হয়। যেখানে এখন জলজ ও প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে। এসব কারণে মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর হতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, ইত্যাদির বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের একুশ শতাংশের বেশি ভূমি পানির নীচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা ওয়াসাসহ সকল নগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নদী বা জলাশয়ের পানি ব্যবহারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে স্বল্প মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মত দেন তারা। সূত্র মতে, দেশে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির চাহিদাও বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে নির্ভর করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। তবে যথেচ্ছভাবে পানি তোলার জন্য ভবিষ্যতে মানুষকে খেসারত দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। এখনই অনেক অঞ্চলের মানুষকে এ কারণে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দিন দিন পানির প্রাপ্যতা কমছে। আবার পানি উত্তোলনে ব্যয়ও বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে খরা প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার এবং ভূগর্ভে পানির প্রবেশ ব্যাহত হওয়ায় পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। অনেক এলাকায় নলকূপে পানি উঠছে না। বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ দিয়ে মাটির নিচ থেকে দিন-রাত অবিরাম পানি তোলা হচ্ছে। রাজশাহীর উত্তরাঞ্চল, গোদাগাড়ী, নওগাঁ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর ও খুলনা অঞ্চলে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নামছে। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলেও স্বাদু বা মিঠা পানির অভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। মানুষ বাধ্য হয়ে ক্ষতিকর পর্যায়ে থাকা নোনা পানি পান করছে। ভূগর্ভেও নোনা পানির অনুপ্রবেশ বাড়ছে। ফসল, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লবণ শরীরে প্রবেশ করায় মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের চালানো এক সমীক্ষা হতে দেখা যায়, অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। পাউবো এবং গবেষকরা বেশ কয়েক দশক পূর্বেই পূর্বাভাস দিয়েছিল ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় শঙ্কার কালোমেঘ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে সবার মাঝে। রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের পরিসংখ্যান বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটার, যা পরবর্তীতে ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার নিচে নামে, ২০১০ সালে ৬০ মিটার ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে এসে যা ৭৫ মিটার নিচে নেমে গেছে। ২০৫০ সালের দিকে যা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১২০ মিটারে নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পুনর্ভরণ কমতে থাকলে উত্তরের জনপদের দশা দেশের অন্যত্রও হতে পারে। একই সঙ্গে দিন দিন ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস কমার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সেচ কাজে কৃষকদের পানি ব্যবহার করতে হবে হিসাব করে। পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও পানির উত্তোলনে লাগাম টানার কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়। তাই সিপিআই সিস্টেমের যন্ত্রপাতি নিয়ে কাস্টম্সের ডিউটি বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি অযৌক্তিক ও অন্যায় বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৬৫টি অগভীর ভূগর্ভস্থ পানির পর্যবেক্ষণ এবং ৪০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও অবস্থান বিশ্লেষণে দেখা যায়, পানির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে নেমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে এক থেকে তিন মিটার পর্যন্ত পানি স্তর নেমে যাচ্ছে। এরপর ‘দ্য গ্যাঞ্জেস ওয়াটার মেশিন কোয়ান্টিফায়ের ফ্রম পিজামেট্রে ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় পানির পুনর্ভরণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি কূপের পানির স্তর নামছে। পুনর্ভরণ প্রায় হচ্ছে না। ১৯৭০ থেকে ২০২০ সাল-এ সময়ের পানির স্তর ও পুনর্ভরণ চিত্র উঠে আসে গবেষণায়।। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ ডিপ টিউবওয়েল ও শ্যালো টিউবওয়েল রয়েছে। ফসল উৎপাদনের জন্য এসব টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে বিভিন্ন ধরনের সেচ কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রচলিত এসব ডিপ টিউবওয়েল ও শ্যালো টিউবওয়েলের মাধ্যমে যে পানি উত্তোলন করা হয় তার সঠিক ব্যবহার হয় মাত্র ৫০ শতাংশ। বাকি পানি অপচয় হয়। এই অপচয়ের কারণে বাংলাদেশের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আলামত শুরু হয়েছে। পানির অপচয় রোধ করার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সেন্টার পিভট ইরিগেশন (সিপিআই) সিস্টেমে সেচ কাজ পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে পাম্পের মাধ্যমে জমির মাটিতে সরাসরি পানি প্রবাহিত করা হয়। সিপিআই সিস্টেমে স্প্রে আকারে বৃষ্টির মতো করে পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে ফসলের পাতা ও মাটি সুসমভাবে পানি পেয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে পানির ব্যবহার বা কর্মদক্ষতা প্রায় ৮৫ থেকে ৯৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেচ কাজে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাব, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, সেচ প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যা এবং ব্যক্তিগত বিরোধ। এছাড়াও, সেচ প্রকল্পের অব্যবস্থাপনা, সেচ-সংক্রান্ত নীতিমালার বাস্তবায়নে ঘাটতি এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে (যেমন বন্যা ও জলাবদ্ধতা) সেচ সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। জরুরিভাবে যে সব ডিপটিউল গুলি কম পানি উঠে, সেগুলি সংস্কার, পুরঃখনন করা, কাঁচা ড্রেনগুলি বন্ধ করে পাইপ লাইন বসানো জরুরি।

লেখক: মো: হায়দার আলী; সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট