ব্যাংকিং খাতে জমে থাকা দীর্ঘমেয়াদি খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিকে দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে শনিবার অনুষ্ঠিত চতুর্থ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৫ এর উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি বলেন, মোট ঋণের এক তৃতীয়াংশের বেশি এখন খেলাপি, ফলে বাকি অংশের ওপর চাপ বাড়ছে। তার মতে, এ সংকট রাতারাতি কাটানো সম্ভব নয়, ধাপে ধাপে উত্তরণে পাঁচ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
গভর্নর বলেন, আগে খেলাপি ঋণের হার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ধরে বিশ্লেষণ করা হতো, কিন্তু নতুন ক্লাসিফিকেশন নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে এটি ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তিনি মনে করেন, অর্থ পাচার এবং অনিয়ন্ত্রিত আমদানি পরিসংখ্যানের কারণে অতীতে প্রকৃত চিত্র আড়ালে ছিল। এখন হিসাব স্বচ্ছ হওয়ায় প্রকৃত সমস্যা স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ব্যাংকিং খাতে আমদানি এলসি খোলা নিয়ে কোনও চাপ নেই, বরং এই মুহূর্তে যত প্রয়োজন তত আমদানি করা সম্ভব।
অধিবেশনে উপস্থিত অন্যান্য বক্তারা দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যার দিক তুলে ধরেন। বিআইডিএস মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক মানসিকতা ব্যবসায়ীদের আস্থায় আঘাত করছে। তার মতে, করব্যবস্থা আজও জমিদারি ধাঁচে চলছে, যেখানে রাজস্ব আদায়ই প্রাধান্য পাচ্ছে, সেবার মানোন্নয়ন নয়।
হা মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ বলেন, বিভিন্ন সূচকের পতন অর্থনীতির সার্বিক ছবিকে উদ্বেগজনক করে তুলেছে। তার ভাষায়, কঠোর মুদ্রানীতি সুদের হার বাড়িয়েছে, ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নামে মাত্র ৬ শতাংশে নেমে গেছে। শিল্পায়নও প্রায় স্থবির হয়ে আছে।
স্টিল ও শিল্প খাতের প্রতিনিধিরা জানান, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক, অগ্রিম আয়কর এবং টার্নওভার কর বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। তাঁদের মতে, বিশ্বব্যাপী লোকসানী কোম্পানির ওপর কর আরোপের নজির নেই, কিন্তু দেশে লোকসান হলেও কর দিতে হয়, যা শিল্পে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট করছে।
বক্তারা আরও বলেন, ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট বাড়ার পেছনে বন্ড মার্কেট, স্টক মার্কেট ও বিমা খাতের দুর্বলতা বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন জানান, কিছুটা হলেও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরছে। তার ভাষায়, আগে বোর্ডরুমে বসে ঋণ বণ্টন করা হতো, এখন নিয়ম মেনে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। তিনি মনে করেন, নির্বাচন পরবর্তী বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, রমজানের বাজার নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে খোলা হয়েছে এবং ব্যাংক খাতে ডলারের কোনো সংকট নেই। তিনি জানান, ডিপোজিট হার ছয় শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দশ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, সরকারি আমানত উত্তোলন কমলে এটি আরও বাড়তে পারে। পাশাপাশি নয়টি নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্রুত অবসায়নের প্রক্রিয়ায় আছে। ইসলামী ধারার পাঁচ ব্যাংক নিয়ে গঠিত সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমও আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হবে।
তিনি মনে করেন, অতীতে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংক খাতকে সংকটে ফেলেছিল, ভবিষ্যতে এসব হস্তক্ষেপ বন্ধ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।