রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় একটি ভারী পরিবেশে প্রকাশিত হলো দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও বৈষম্যের অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। সেখানে উঠে এসেছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে চলা অসংখ্য অনিয়ম, অন্যায় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য। প্রতিবেদনটি হাতে পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্ট করে বলেন, যেসব সদস্য অন্যায়ভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে সরকার।
রোববার (৩০ নভেম্বর) যমুনা ভবনে কমিটির প্রতিবেদন গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জানান, দায়িত্ব দেওয়ার সময় তিনি ভেবেছিলেন কিছু সীমিত অনিয়ম পাওয়া যাবে। তবে পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তার ভাষায়, কমিটি যে তথ্য তুলে এনেছে তা "কল্পনার বাইরে", এবং এটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে একটি দীর্ঘদিনের অদৃশ্য বাস্তবতার দিক উন্মোচন করেছে।
২০০৯ সাল থেকে ৪ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর চাকরিজীবনে বৈষম্য ও প্রতিহিংসার শিকার হওয়া বরখাস্ত বা অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের অভিযোগ যাচাই করতে কমিটি কাজ করেছে। আবেদন যাচাই শেষে তাদের সামনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা দেশের নিরাপত্তা খাতের একটি অন্ধকার অধ্যায়কে সামনে নিয়ে আসে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল আব্দুল হাফিজ জানান, কমিটি সর্বমোট ৭৩৩টি আবেদন পায়। এর মধ্যে ৪০৫টি গ্রহণ করা হয় এবং বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ১১৪টি আবেদনে নির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়। অভিযোগগুলো নিয়ে অভ্যন্তরীণ নথি পর্যালোচনা, সাক্ষাৎকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং অধিনায়কদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে।
তদন্তে উঠে আসে, ছয় জন অফিসারকে তাদের পরিবারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা মিথ্যা জঙ্গি অপবাদে বিভিন্ন মেয়াদে গুম করে রাখা হয়েছিল। একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সাজানো জঙ্গি নাটকের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রীকেও এক বছরের শিশুসহ দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে রাখা হয়েছিল।
বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পর সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কয়েকজন অফিসারকে সাজানো মামলায় নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে। ১/১১ সময়কার অভিযানের সঙ্গে যুক্ত পাঁচ কর্মকর্তা মিথ্যা অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে প্রশ্ন তোলার দায়ে কয়েক অফিসারকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়াই অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
ধর্মীয় অনুশীলন নিয়মিত পালন করায় চারজন কনিষ্ঠ অফিসারকে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে বরখাস্তের ঘটনাও তদন্তে উঠে এসেছে। আরও জানা যায়, ২৮ জন কর্মকর্তা গুম, অপহরণ, অবৈধ আটক, নির্যাতন, জেরা এবং প্রহসনের তদন্তসহ নানাবিধ শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেনাবাহিনীতে বঞ্চিত ১১৪ জন কর্মকর্তার স্বাভাবিক অবসর, পদোন্নতি, অবসর পূর্ব পদোন্নতি, বকেয়া বেতন ও সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। চারজনকে চাকরিতে পুনর্বহালের প্রস্তাব দেওয়া হয়। নৌবাহিনীতে ১৯ জন এবং বিমানবাহিনীতে ১২ জন কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও একই ধরনের আর্থিক ও প্রশাসনিক পুনর্বহাল সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির কাজের প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "পূর্ণ পেশাদারিত্ব ও নির্মোহ অবস্থান বজায় রেখে আপনারা সত্য তুলে ধরেছেন। এই সত্য দেশকে সামনে এগোতে সাহায্য করবে।" তিনি আরও জানান, সরকার এসব সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং বঞ্চিত সামরিক সদস্যরা ন্যায়বিচার পাবেন।
সভায় কমিটির সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মুহম্মদ শামস উল হুদা, মেজর জেনারেল (অব.) শেখ পাশা হাবিব উদ্দিন, রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ শফিউল আজম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মুহাম্মদ শাফকাত আলী, সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ তারিকসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।