বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত বছরের ডিসেম্বরে পরিচালিত অর্থনৈতিক শুমারিতে দেশের ছোট-বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি। তবে গণনা-পরবর্তী যাচাই (পিইসি) কার্যক্রমে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানায়, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি-১ কোটি ২২ লাখ ৪২ হাজার ৮৩৬টি। অর্থাৎ শুমারিতে বাদ পড়েছে প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার প্রতিষ্ঠান, যা মোটের ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ৫ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য গ্রহণযোগ্য হলেও এ বিচ্যুতি দেশের অনানুষ্ঠানিক ও দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক বাস্তবতার একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। বিআইডিএসের তথ্য মতে, বাদ পড়া ব্যবসাগুলোর বড় অংশ অস্থায়ী, মৌসুমি বা ভাসমান প্রকৃতির-যারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত হয়। শহরাঞ্চলে এ হার আরও বেশি, বিশেষ করে সিটি করপোরেশন এলাকায় যেখানে ব্যবসার দ্রুত রদবদল, নতুন উদ্যোগ এবং অনিবন্ধিত ক্ষুদ্র ব্যবসার আধিক্য দেখা যায়। এসব কারণে শুমারির সময় অনেক প্রতিষ্ঠান গণনাকর্মীদের কাছে অদৃশ্য রয়ে গেছে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাক কারখানাসহ কিছু স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান গণনাকর্মীদের প্রবেশে বাধা দেওয়ায় অন্তর্ভুক্তির ঘাটতি তৈরি হয়। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তারের মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও পরিস্কার করে-রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, প্রশাসনিক রদবদল এবং বৈরিতা শুমারি কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা অনুপস্থিত থাকা, গণনাকর্মীদের সহায়তায় অনীহা এবং শুমারির প্রতি সামগ্রিক উদাসীনতা এ ঘাটতির কারণ। অথচ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিক বিবিএসের তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করতে বাধ্য। এ জায়গায় গুরুত্ব পেয়েছে আরেকটি দিক-শুমারির মাঠপর্যায়ের কর্মীদের প্রতি অবহেলা। পরিকল্পনা বিভাগের সচিব শাকিল আকতার যথার্থই বলেছেন, তথ্য সংগ্রহ যেকোনো শুমারির কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু বাস্তবে গণনাকর্মীরা কাঙ্ক্ষিত গুরুত্ব ও সহায়তা পান না। তারা যদি তথ্য সংগ্রহে বাধার সম্মুখীন হন, তবে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র কখনোই সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে না। শুমারির এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও একটি ইতিবাচক দিক হলো-ত্রুটির হার গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যেই আছে। তবে এটি আত্মতুষ্টির কারণ নয়। বরং ভবিষ্যৎ শুমারিতে অস্থায়ী ও অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য স্বতন্ত্র পদ্ধতি উন্নয়ন, নিবন্ধন ব্যবস্থা সহজীকরণ, ব্যবসায়ীদের সচেতন করা এবং গণনাকর্মীদের প্রতি সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিক শুমারিকে নির্ভুল করা শুধু পরিসংখ্যানগত অনুশীলন নয়; এটি দেশের বাজেট, নীতি প্রণয়ন, শিল্পোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান পরিকল্পনার ভিত্তি। প্রকৃত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা জানা না থাকলে অর্থনীতি পরিচালনার নকশায় ভুল থাকার ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই শুমারির ঘাটতি চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ-এটাই সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ।