সড়ক দুর্ঘটনা যেন আমাদের জাতীয় জীবনে এক স্থায়ী অভিশাপের নাম। প্রতিদিন সড়কে ঝরছে প্রাণ। খবরের কাগজে ভেসে উঠছে বীভৎস লাশের ছবি। নিহতের স্বজনদের চিৎকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করলেও তা যেন আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারছে না। পরিবারের যে মানুষটি ছিল একমাত্র অবলম্বন, একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। এখন মহাসড়কেও ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করে। এ থেকেই স্পষ্ট দেশে সড়কের বিশৃঙ্খলা কী ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। জনগণের দীর্ঘদিনের দাবিতে দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহর আইন হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ-সংক্রান্ত কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল। নির্দেশনাগুলো হলো, দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলোও বারবার আলোচনায় আসে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদ করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও কেন কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসার এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না বলেই মনে হয়, যে কারণে কমছে না দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধান একা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। সরকার, পরিবহন মালিক, চালক, পথচারী এবং নাগরিক সমাজ—সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।