বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান বলেছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন হলেও এর কালো ছায়া এখনো রয়ে গেছে। এক দল লুটপাট করে দেশে-বিদেশে বেগম পাড়া বানিয়েছে। খুন, গুম, জুলুম নিপীড়ন করেছে। শেষ পর্যন্ত জনরোষে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কলাপাতায় শুয়েও কারো রক্ষা হয়নি। আরেক দল খুনোখুনি করে নিজেদেরকেই শেষ করে দিচ্ছে। সিলেট থেকে ৮ দলের সমাবেশ শেষ হচ্ছে, এই সিলেট থেকেই বিজয়ের শুরু হবে। ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হলেও জুলাই আকাঙ্খা পূরণে তারা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাদের সংস্কার ও গণভোটে আপত্তি। শেষ পর্যন্ত মানলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ভোটের দিনে গণভোট আয়োজনে সরকারকে বাধ্য করেছে। তারা শুধু নির্বাচন চেয়ে পাগল হয়েছিলেন। এখন তাদের কেউ কেউ নির্বাচন পেছানোর জন্য ভিন্নসুরে কথা বলছেন। নির্বাচন নিয়ে কোন টালবাহানা জনগণ মেনে নিবেনা।
তিনি শনিবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেলে সিলেটের ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে ইসলামী ও সমমনা ৮ দলের সিলেট বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত কথা বলেন। মূল সমাবেশ বেলা ২টা থেকে শুরু হলেও বেলা ১১টা থেকেই শুরু হয় আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ মুখী জনস্রোত। বেলা ১টার আগেই মাঠ লোকে লোকারন্য হয়ে আশপাশের এলাকা জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে। ৮ দলের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ দলের প্রতীক সম্বলিত ব্যানার, ফ্যাস্টুন ও প্লেকার্ড হাতে স্লোগানে মুখর হন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীরে জামায়াত বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জাতির আশা আকাঙ্খা পূরণে দেশপ্রেমিক ইসলামী ও সমমনা ৮ দল মাঠে রয়েছে। আমাদের যেসব ইসলামী দলের ভাইয়েরা এখনো বাকী রয়েছেন, আপনাদেরকেও আমাদের সাথে আসার অনুরোধ করছি। এটা আপনাদেরই আঙ্গিনা, আপনাদের স্বাগত জানাতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত। আপনারা ইসলামী ও দেশপ্রেমিক দলের নেতা হয়েও কেনো চাঁদাবাজ ও দখলদারদের অপবাদ নিতে যাবেন। তাই আপনাদেরকে ইসলাম ও দেশের স্বার্থে ফিরে ৫ দফা দাবীর আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আপনাদের নিয়েই আমরা সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজমুক্ত মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই। সিলেটের মানুষ অতীতেও আওয়ামী লীগকে লাল কার্ড দেখিয়েছিলো। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও সিলেট গর্জে উঠেছিল। এই সিলেটের মাটিতেই ৮ দল সর্বশেষ সমাবেশ বাস্তবায়ন করেছে।
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, আমাদেরকে বিভিন্ন শক্তির ভয় দেখানো হয়। যারা হাসিমুখে ফাঁসির রশি গলায় পড়ে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা আল্লাহ ছাড়া কাউতে পাত্তা দিতে চাইনা। জুলুম, চাঁদাবাজী ও দখলবাজি বন্ধ করুন। জনগণ আর এসব বরদাশত করবেনা। মানবিক বাংলাদেশে আর কাউকে ফ্যাসিবাদী আচরণ করতে দেয়া হবেনা। কারণ জনগণ আজ জেগে উঠেছে। জনতার বিজয় হবেই।
খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা আব্দুল বাসিত আজাদের সভাপতিত্বে ইসলামী ও সমমনা ৮ দল সিলেট জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দের যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর সৈয়দ মোঃ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর শায়খ মাওলানা মামনুল হক, খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাদের, জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ প্রফেসর মাওলানা মুহাম্দ ইউনুছ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা রেজাউল করিম জালালী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিয়াজী, নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল মজিদ আতাহারি, বাংলাদেশ ডেভোলাপমেন্ট পার্টি-বিডিপির সভাপতি এডভোকেট এ.কে.এম আনোয়ারুল হক চান, জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-জাগপার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ মোঃ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, আজকে বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪ বছর ধরে যারা আমাদেরকে জিম্মি করে রেখেছিল, তাদেরও চরিত্র আমরা দেখেছি। যে তারা নিজেদের কাছে নিজেরা নিরাপদ নয়, আজকে তারা নিজেরা নিজেদের খেয়ে ফেলছে। আমার দুঃখ হয়, আজকে এত গুম হল, এত খুন হলো, লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী যুগ যুগ পর্যন্ত তাদের জীবনকে বিপন্ন করলো জেলের মধ্যে। আমাদের দাবী ছিল, ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের খুনীদের বিচার হবে, এই খুনীদের লক্ষ, কোটি টাকা পাচারকারীদের বিচার হবে। এরপরে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু, আমরা দেখে হতবাক, আজকে সংস্কারে বাঁধা, দৃশ্যমান বিচারে বাঁধা, নির্বাচনের জন্য যেন তারা পাগল হয়ে গিয়েছিল, আজকে যখন তারা দেখেছে বাংলাদেশের জনগণ ফ্যাসিস্টদের পক্ষে এবং জালেম-চাঁদাবাজদের পক্ষে নয়, ওদের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছে। এখন ওরা পাগল হয়ে গেছে আজকে নির্বাচনকে আবার পেছানোর জন্য। কিন্তু, আমরা পরিষ্কার বলবো- রাশি যখন বামে ঘুরে, তখন যত পরিকল্পনা সব বামেই যায়। আপনারা যত শয়তানি পরিকল্পনা করবেন, ততই আপনারা বাংলাদেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
তিনি বলেন, ৫৩ বছর আমাদেরকে যারা জিম্মি করে রেখেছিল, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে ৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দান করেছেন। এই স্বাধীনতার ফসল যারা আমরা দেশপ্রেমিক রয়েছি, যারা আমরা জনতাপ্রেমী রয়েছি, যদি আমরা ভুল করে থাকি, যদি আমরা ব্যর্থ হই, যখন ইতিহাস আমাদের প্রজন্ম লিখবে, তখন কলঙ্কজনক ইতিহাস আমাদের জন্য লিখবে। এই জন্য আমি সকলকে উদ্ধাত্ত আহবান জানাবো, আসেন আমরা যারা দেশপ্রেমিক রয়েছি, ক্ষমতাপ্রেমিকদেরকে, চাঁদাবাজদেরকে আমাদের দেশের টাকা যারা বিদেশে পাঁচার করে, তাদেরকে আমরা না বলার মাধ্যমে আমরা বাংলার জমিন থেকে চিরতরে উৎখাত করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর শায়খ মাওলানা মামনুল হক বলেন, দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে, বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তির বাংলাদেশী ক্রীড়নকদের হাতে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ নিপীড়িত হয়েছেন, কারানির্যাতিত হয়েছেন, ফাঁসির কাষ্ঠে বরণ করেছেন, জেলজুলুমের শিকার হয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তবুও অন্যায়ের সামনে, জুলুমের সামনে মাথানত করে নাই। তাই, আজ যখন জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তি বিতাড়িত হয়েছে, বাংলাদেশ বিরোধী বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তি তারা আবার বাংলাদেশে নতুন আরেক শক্তির ঘাড়ে সওয়ার হওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, জীবন দিয়ে জুলাই যোদ্ধারা বাংলার মাটি থেকে যেই ফ্যাসিবাদ এবং বিদেশী কায়েমি শক্তিবাদীকে উৎখাত করেছে, বাংলার মাটিতে নতুন কোনো ফ্যাসিবাদীকে জায়গা করতে দিবে না, ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, ২০২৬ সালের যে নির্বাচন, এটি শুধু প্রতীকের নির্বাচন নয়, এটি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঐতিহাসিক গণভোটের নির্বাচন। তাই ৮ দলের নেতাকর্মীরা প্রতি ঘরে ঘরে, প্রতি জনে জনে নিজেদের দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি গণভোটের ‘হ্যা’কে বিজয়ী করতেও কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে আজ বাংলাদেশ আজ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়েছে। একটি পক্ষ যে কোনো বাহানায় জুলাই সনদকে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে চায়। তারা চিন্তা করে বিগত সময়ে, বছরের পর বছর, একদল শাসন করেছে, আগামীতেও কোনো দল বছরের পর বছর একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের মধ্যে দিয়ে বাংলার সম্পদ লুটপাট করবে, মানুষের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করবে। আমরা বার্তা দিতে চাই, জুলাই সনদের বিপক্ষে যারা না বাক্সে ভোট দেওয়ার জন্য ক্যাম্পেইন করবে, বাংলার মানুষ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে, প্রত্যাখ্যান করবে। ইনশাআল্লাহ।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিয়াজী বলেন, একটি দল ইসলামী দলের সাথে সব সময় প্রতারণা করে আসছে। তারা শরিয়া আইনে বিশ্বাস করেনা। এদের সাথে ইসলামী দলের কোন সম্পর্ক থাকতে পারবেনা। আগামী ইসলামী ও সমমনা ৮ দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করে তাদের শিক্ষা দিতে হবে।
বাংলাদেশ ডেভোলাপমেন্ট পার্টি-বিডিপির সভাপতি এডভোকেট এ.কে.এম আনোয়ারুল হক চান বলেন- দেশের সবগুলো বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের স্বাধীনতার সুফলকে জাতির ঘরে পৌছে দিতে হবে। ইশ্বরদিতে কুকুর ছানা হত্যা নির্মম, এটার নিন্দা আমরাও জানাই। কিন্তু এটাকে নিয়ে মিডিয়ার অতিকথন উদ্দেশ্যপ্রনোদিত। অথচ সীমান্তে ভারতের মানুষ হত্যা নিয়ে মিডিয়া নিরব থাকা ঠিক নয়। আমরা স্বাধীন নিরপেক্ষ মিডিয়া চাই। বাংলাদেশ রুখে দাড়িয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অর্জন নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র চলবেনা। প্রয়োজনে আবার জুলাই বিপ্লবের ডাক দেয়া হবে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-জাগপার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান বলেন, আজকে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ কর্মসূচী শেষ হয়েছে। নতুন করে জেগে উঠা জালিমরা যদি মনে করে ৮ দলের কর্মসূচী শেষ। তাদেরকে বলে দিতে চাই দেশে নতুন করে আর কোন ফ্যাসিবাদ তৈরী