মুক্তির পর থেকেই বক্স অফিসে তাণ্ডবের পাশাপাশি প্রবল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে আদিত্য ধর পরিচালিত রাজনৈতিক ড্রামা ও স্পাই থ্রিলার ‘ধুরন্ধর’। শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা একদিকে আয়ের নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে, অন্যদিকে বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে মিল, অতিরঞ্জিত উপস্থাপন, সমালোচকদের ওপর ট্রল এবং তারকাদের মন্তব্য ঘিরে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই ছবিটি যে গতিতে এগিয়েছে, তাতে বলিউডের বাণিজ্যিক ছবির তালিকায় আলাদা জায়গা করে নিয়েছে ‘ধুরন্ধর’। টানটান অ্যাকশন, রাজনৈতিক বক্তব্য আর স্পাই-নাটকীয়তায় দর্শকের একাংশ মুগ্ধ হলেও, আরেক অংশ প্রশ্ন তুলেছে ছবির বক্তব্য ও উপস্থাপন নিয়ে।
সিনেমার গল্প শুরু হয় ১৯৯৯ সালের কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার মধ্য দিয়ে। এরপর উঠে আসে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে হামলা এবং মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রসঙ্গ। গল্পে দেখানো হয়, পাকিস্তানের মদদে পরিচালিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রচলিত ব্যবস্থায় লড়াই সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। সেই লক্ষ্যেই রণবীর সিং অভিনীত এজেন্ট হামজাকে পাঠানো হয় করাচির লিয়ারে, সিস্টেমের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে।
এই প্রেক্ষাপটেই সিনেমাটি প্রশংসা কুড়িয়েছে রোমাঞ্চ, অ্যাকশন ও অভিনয়ের জন্য। অনেক সমালোচকের মতে, মূলধারার বাণিজ্যিক কাঠামোর মধ্যেই ভূরাজনীতির জটিল দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। ছবিতে রণবীর সিংয়ের সঙ্গে অভিনয় করেছেন অক্ষয় খান্না, সঞ্জয় দত্ত, অর্জুন রামপাল, সারা অর্জুন ও আর মাধবন।
বক্স অফিসের হিসাবেও ‘ধুরন্ধর’ নজর কেড়েছে। মুক্তির সাত দিনের মধ্যেই ছবিটি ভারতীয় বাজারে ২০০ কোটির ঘর পেরিয়েছে। বক্স অফিস বিশ্লেষক সংস্থা স্যাকনিকের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম সপ্তাহে ভারতে ছবিটির আয় দাঁড়িয়েছে ২০৭ কোটি রুপি। এর ফলে আদিত্য ধর এখন তাকিয়ে আছেন নিজেরই পরিচালিত ‘উরি’ সিনেমার রেকর্ডের দিকে, যার মোট আয় ছিল ২৪৪ কোটি রুপি।
এই সাফল্যের মধ্যেই বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন অক্ষয় খান্না। সিনেমায় তাঁর অভিনীত রেহমান ডাকাত চরিত্রটি বাস্তবের কুখ্যাত পাকিস্তানি মাফিয়া রেহমান ডাকাতের আদলে কি না, তা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। রেহমান ডাকাত, যার আসল নাম সর্দার আবদুল রেহমান বালুচ, অল্প বয়সেই অপরাধজগতে জড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষে উঠে এসেছিলেন। যদিও নির্মাতাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চরিত্রটি বাস্তব কোনো ব্যক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি বলে স্বীকার করা হয়নি।
এ ছাড়া রণবীর সিং অভিনীত হামজা চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের দাবি, চরিত্রটি ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা প্রয়াত মেজর মোহিত শর্মার আদলে গড়া। মুক্তির আগেই তাঁর পরিবার অভিযোগ তোলে, বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিল থাকা সত্ত্বেও যথাযথ কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি। পরে ভারতের সার্টিফিকেশন বোর্ড ও পরিচালক স্পষ্ট করে জানান, ছবিটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির জীবনী নয়।
পাকিস্তানেও সিনেমাটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া কম নয়। দেশটির বিশ্লেষক ও সংবাদমাধ্যমগুলোর মতে, করাচির গ্যাং সংস্কৃতি ও অপরাধজগতকে অতিরঞ্জিতভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করে দেখানো হয়েছে। তাদের দাবি, বাস্তবে এসব দ্বন্দ্ব ছিল স্থানীয় দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অবহেলা ও সামাজিক বৈষম্যের ফল। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা চৌধুরী আসলামের ভূমিকার কথাও তারা তুলে ধরেছে, যিনি নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে গ্যাং দমন করেছিলেন।
সমালোচকদের ঘিরে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সিনেমায় অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভিযোগ তুলে যাঁরা নেতিবাচক রিভিউ দিয়েছেন, তাঁদের অনেককেই অনলাইনে আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। প্রখ্যাত সমালোচক অনুপমা চোপড়া চাপের মুখে দ্য হলিউড রিপোর্টার ইন্ডিয়া থেকে নিজের ভিডিও রিভিউ সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। তাঁর রিভিউতে তিনি লিখেছিলেন, বাস্তব ঘটনার আসল ফুটেজ ব্যবহার গল্পকে উত্তেজনাপূর্ণ করলেও বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণ কিছুটা অগোছালো হয়ে উঠেছে।
এই আবহে বিতর্কে জড়ান অভিনেতা হৃতিক রোশনও। ইনস্টাগ্রামে ‘ধুরন্ধর’-এর প্রশংসা করে তিনি লেখেন, সিনেমাটি তাঁকে নাড়া দিয়েছে। তবে একই পোস্টে রাজনৈতিক দিক নিয়ে ভিন্নমত থাকার কথা বলায় শুরু হয় তীব্র ট্রল। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি পরে আরেকটি পোস্ট দিলেও বিতর্ক তখন ছড়িয়ে পড়েছে।
সব মিলিয়ে ‘ধুরন্ধর’ প্রমাণ করেছে, বর্তমান সময়ে সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, মতাদর্শের সংঘাতের ক্ষেত্রও। প্রথম কিস্তির সাফল্যের পর আগামী বছর ‘ধুরন্ধর ২’ আসার ঘোষণা রয়েছে। সে পর্যন্ত বক্স অফিসে যেমন দাপট দেখাবে এই সিনেমা, তেমনি বিতর্কও যে থামছে না, সেটাই এখন স্পষ্ট।