ছায়ানটের ভেতরে পোড়া বই আর ভাঙা বাদ্যযন্ত্র, বাইরে কড়া পুলিশ পাহারা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০১:০৮ পিএম
ছায়ানটের ভেতরে পোড়া বই আর ভাঙা বাদ্যযন্ত্র, বাইরে কড়া পুলিশ পাহারা

রাজধানীর ধানমন্ডিতে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির ভেতরের অবকাঠামো ও সাংস্কৃতিক সম্পদ। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যেই বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) গভীর রাতে এই হামলা হয়। ঘটনার পর শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোর থেকে ভবনের সামনে পুলিশ পাহারা জোরদার করা হয়েছে।

সরেজমিন ছায়ানট ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, ভবনের সামনে অগ্নিসংযোগের চিহ্ন এখনো স্পষ্ট। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ছিন্নভিন্ন কাগজপত্র, ভাঙা চেয়ার-টেবিল আর তছনছ করা অফিস কক্ষ। দ্বিতীয় তলার অফিস, ক্যান্টিন ও অডিটোরিয়ামসহ তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিভিন্ন কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে। পঞ্চম তলার লাইব্রেরিতে আগুন দেওয়ায় পুড়ে গেছে বহু দুষ্প্রাপ্য বই ও নথিপত্র। দ্রুত ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোয় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে ভবনটি রক্ষা পায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত দেড়টা থেকে আড়াইটার মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি দল মুখে কাপড় বেঁধে ও হেলমেট পরে ভবনের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। তারা তবলা, হারমোনিয়াম, তানপুরাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে এবং কিছু অংশে আগুন দেয়। মিলনায়তনের মনিটরিং সিস্টেম, সিসি ক্যামেরা, স্পিকার, লাইট ও ফ্যান ভাঙচুর করা হয়। প্রয়াত সন্‌জীদা খাতুনের প্রতিকৃতিও নষ্ট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, “শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। কিন্তু তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ছায়ানটে এমন হামলা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।” তিনি জানান, ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো করা সম্ভব হয়নি, তবে নথিগত কিছু দুষ্প্রাপ্য বই ও কাগজপত্র আগুনে পুড়ে গেছে।

এই হামলায় সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা। অভিভাবক আফরোজা খাতুন বলেন, “এটা শুধু একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান না, এটা আমার সন্তানের স্কুল। রাতে ভিডিও দেখে ছেলে বলছিল, মা আমাদের স্কুল ভেঙে ফেলছে। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।” তিনি অভিযোগ করেন, সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সময়মতো ব্যবস্থা নেয়নি।

শংকরের বাসিন্দা সুশান্ত রায় বলেন, “হাদির হত্যার বিচার আমরা সবাই চাই। কিন্তু ছায়ানটে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সংস্কৃতির ওপর সরাসরি আঘাত।” তার স্ত্রী দীপান্বিতা রায় জানান, সারা রাত উদ্বেগে কাটিয়েছেন তারা।

ধানমন্ডি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিথুন সিংহ জানান, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভাঙচুরের ঘটনার পরপরই ছায়ানটে হামলা হয়। রাত আড়াইটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিলেও তার আগেই ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। ধানমন্ডি থানার উপ-পরিদর্শক খলিলুর রহমান বলেন, “শুক্রবার সকাল থেকে ছায়ানট ভবনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”

হামলার পর ছায়ানটের ফেসবুক পেজে জানানো হয়, পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।

১৯৬১ সালে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও চেতনা বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট অতীতেও হামলার শিকার হয়েছে। ২০০১ সালে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন। সেসব আঘাত পেরিয়েও ছায়ানট সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে গেছে। এবারও সংগঠনটির সদস্য, শিক্ষার্থী ও শুভাকাঙ্খীরা সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন, এই হামলা তাদের পথচলা থামাতে পারবে না।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে