আমরা প্রতিনিয়ত ভুলে যাই- ১টি বড় গাছ ৪-জন মানুষের অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে পারে। ভুলে যায় আমাদের অতি লোভী ব্যবসায়ী চক্র যে, জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে গাছের চেয়ে বড় কোনো বন্ধ নেই পৃথিবীতে। গাছের চেয়ে বড় বন্ধু না থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও কখনোই গাছ কাটা বিষয়ে কোনো মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করেনি কখনো। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে সকল সরকারের চেয়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতা। এই উদ্যোগের কারণে নির্মমভাবে বাংলাদেশে গাছ কাটা কমবে বলেই আমি আশাবাদী। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- যুক্তরাজ্যে মাথাপিছু গাছের সংখ্যা ৪৩টি, চীনে ১৩০টি, ইথিওপিয়ায় ১৪৩টি, স্কটল্যান্ডে ৪০০টি, আমেরিকায় ৬৯৯টি, অস্ট্রেলিয়ায় ১২৬৯টি, ব্রাজিলে ১৪৯৪টি, কানাডায় ১০,১৬৩টি, ভারতে ১-জন মানুষের জন্যে প্রায় ২৮টি গাছ আছে, আর রাশিয়ায় প্রত্যেক নাগরিকের জন্যে আছে ৬,৬১৪টি গাছ! আর এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্যে মাথাপিছু কয়টি গাছ আছে তা খুঁজে পাইনি। কারণ কি? উত্তর হিসেবে আমি মনে করি জনশুমারি হলেও গাছ শুমারি হয়নি গত ৫৩ বছরের একটি সরকারের সময়ও। আমি চাই গাছ শুমারি হোক, আমার এই চাওয়ার সাথে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা-সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই ঐকমত্য হবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। এতে অন্তত প্রতি বছর বাংলাদেশে ৭ কোটিরও বেশি গাছ কাটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। তা না হলে অতীতের মত তপ্ত হবে বাংলাদেশ। শীত শেষ হতেই যেন নির্মম গরমে মানুষ অসুস্থ না হয়, সে লক্ষ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে হলেও গাছ কাটারোধ করতে হবে। কেননা, লম্বা সময় ধরে গাছ কাটা, বন উজাড়ের ফল এখন ভোগ করতে শুরু করেছে দেশের মানুষ। একটি দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি ঠিক রাখতে অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার হলেও বাংলাদেশে মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে, যা সত্যিই বেদনার। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট পরিচালিত প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৬ লাখ ৭ হাজার ৬২০ একর। এই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ আগের তুলনায় ১৩ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০১৭ সালে; প্রায় ৭০ হাজার একর। ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ লাখ সাড়ে ৯৬ হাজার একর (২০ লাখ ২২ হাজার হেক্টর) প্রাকৃতিক বনভূমি ছিল, যা মোট ভূমির ১৬ শতাংশ। প্রতিবছরই সেই বনভূমি কমছে। শুধু ২০২৩ সালেই বনভূমি কমেছে প্রায় ৪৪ হাজার একর। এই বিশাল এলাকার গাছগাছালি ধ্বংস না হলে অন্তত ৭৫ মেগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঠেকানো যেত বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের তথ্যে আরো উঠে এসেছে- ২০০১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সবচেয়ে বেশি কমেছে চট্টগ্রামে; ৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৭০ একর, যা মোট কমে যাওয়া বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার ৯৪ শতাংশ; এরপর যথাক্রমে আছে সিলেট, সেখানে কমেছে ২০ হাজার ৬৭৪ একর, ১৩ হাজার ৯৮০ একর, রংপুরে কমেছে ১ হাজার ১৯০ একর, রাজশাহীতে ৭৯৮ একর, খুলনায় ৫০১ একর, বরিশালে কমেছে প্রায় ২৪৫ একর। আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বরাবরই গাছ কাটার বিপক্ষে যেমন ছিলাম, তেমন আছি গাছ লাগানোর মত একটি উদ্যোগের সাথে ২৭ বছর ধরে। একদিকে কষ্ট-শ্রম- মেধায় অর্জিত অর্থ দিয়ে গাছ লাগিয়েছি, অন্যদিকে কিছু রাক্ষস শ্রেণির মানুষ সেই গাছ কেটে কেটে বিক্রি করেছে। আর এই কারণেই গত ২০ বছরে চট্টগ্রাম অঞ্চল যে পরিমাণ বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা হারিয়েছে, তার ৭৬ শতাংশই বান্দরবান ও রাঙামাটিতে। এই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সবচেয়ে বেশি উজাড় হয়েছে বান্দরবানে- ২ লাখ ৯ হাজার ৭৯২ একর। এছাড়া রাঙামাটিতে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬১০ একর, খাগড়াছড়িতে ৬০ হাজার ৫৪১ একর, চট্টগ্রামে ২৩ হাজার ১০৪ একর ও কক্সবাজারে ২২ হাজার ৭৮৩ একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ধ্বংস হয়েছে। এই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। তালিকায় প্রথম নামটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনাম; যেখানে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৬ লাখ ২২ হাজার ৪৪০ একর, দ্বিতীয় স্থানে থাকা দেশটি হচ্ছে আফ্রিকার দেশ মালাউই; সেখানে কমেছে ৬ লাখ ১০ হাজার ৯০ একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমি। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ২২ হাজার ৪৪৫টি স্থানে বৃক্ষ নিধন হতে পারে বলে সতর্ক করেছিলো প্রতিষ্ঠানটি। কে শোনে কার কথা। সবাই ক্ষমতার জোর দেখিয়ে একের পর এক কাছ কেটেছে। এসব এলাকায় প্রায় ৬২৯ একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা উজাড় হয়ে গেছে এরই মধ্যে। বাংলাদেশের যে-সব স্থানে বৃক্ষ নিধনের বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিলো, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে চট্টগ্রামে। উজাড় হওয়ার শঙ্কায় থাকা ভূমির ৭২ শতাংশই (৪৫৬ একর) চট্টগ্রামের। বাদবাকি এলাকাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে ঢাকা। ঢাকায় ১২১ একর, সিলেটে ৩৭ একর, রংপুর ও খুলনায় প্রায় ৫ একর করে, রাজশাহীতে ২.৫০ একর এবং বরিশালে প্রায় ২ একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা উজাড় হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অবশ্য দেশের বন ও বনভূমি দেখভালকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ছিল ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। এর মধ্যে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একরই বেদখল হয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি বনভূমি বেদখল হয়েছে কক্সবাজার জেলায়। জেলাটিতে ৫৯ হাজার ৪৭১ হাজার একর বনভূমি বেহাত হয়েছে। প্রতিবছর আমরা প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বন হারাচ্ছি। আবার নতুন করে বাড়ছেও। কিন্তু, কার্বনের দিক থেকে যদি চিন্তা করেন, গেইনের থেকে আমাদের লস বেশি। অর্থাৎ, নিট লস আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বন বেশি কমছে, আবার গাজীপুর কেন্দ্রিক শালবন কমছে। এগুলো মনুষ্যসৃষ্ট কারণে। আবার যদি সুন্দরবনের দিকে দেখেন, ওখানে বন তেমন কমেনি। যেটুকু কমেছে, সেটা ভাঙনজনিত বা অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে। একথাও সরকারের সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি সকলের মনে রাখতে হবে- বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বা বনভূমি কমে যাবার পেছনে যেমন অপরিকল্পিত নগরায়ণ দায়ী, তেমনি দায় আছে জল, বায়ু ও মাটি দূষণ এবং নদী ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক কারণ। যে হারে গাছ কমছে, সে হারে লাগানো হচ্ছে না এটিও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। আবার লাগানো হলেও পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই মারা যায়। বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি করলে হবে না। আমরা তো শুধু বৃক্ষ রোপণ করি। বরং ‘গাছ লাগাই, গাছ বাঁচাই’ এভাবে করতে হবে। অর্থাৎ শুধু রোপণ করলেই হবে না, বরং পরিচর্যাও দিতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো নদীভাঙন। প্রতিবছর নদী-ভাঙনের ফলে আমাদের প্রচুর গাছ-পালা কমে যায়। সেজন্য, আমাদের নদীগুলোও রক্ষা করতে হবে। তা না হলে স্মরণীয় করে রাখতে হবে ভয়াবহ ২০২৪ সালকে। সে বছর এক মাস ধরে তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ, যার শুরু ৩১ মার্চ। এর মধ্যে ৩০ এপ্রিল দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় এবং মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো যশোরে ৪৩ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালে ৫-৩০ এপ্রিল টানা ২৬ দিন, ২০১৬ সালে ছিল ৬-৩০ এপ্রিল ২৫ দিন। ২০২৩ সালে ১৩ এপ্রিল থেকে ৫ মে ২৩ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। এমন বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে বাংলাদেশের সকলকেই। গাছ কাটায় দেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা মাথায় রেখে এগিয়ে ছাত্র-যুব-জনতার বাংলাদেশ। এটি অত্যন্ত আশা জাগানিয়া বিষয়। হয়তো সেই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হয়েই গাছ কাটতে অনুমতি লাগবে বলে এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে গ্রাম পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানার গাছ কাটতে অনুমতি লাগবে না, এই বিষয়ে আমার মত হলো- মনিটরিংটা রাখা প্রয়োজন। যাতে করে তিনি অহেতুক কোনো গাছ কাটার উদ্যোগ না নেন। গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে জনস্বার্থে করা রিটের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা-শ্রদ্ধা রেখে আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করাটা একজন রাজনীতি- দেশ-শিক্ষা-সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে খুবই জরুরি মনে করছি। সেই সাথে তাঁর বক্তব্য- ‘এই রায়ের ফলে গাছ কাটতে অনুমতি নিতে হবে কমিটি থেকে। ঢাকা ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এই কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সাতদিনের মধ্যে ঢাকায় কমিটি গঠন করতে বলেছেন আদালত। পরিবেশবাদী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে।’-এর সূত্রতায় বলতে চাই- আর যেন ভূত ছাড়ানোর সরিষায় ভূত প্রবেশ না করতে পারে, সেই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে আমাদের সকলকে। আসুন অসংখ্য কাজের ভিড়ে আরেকটি কাজ সামর্থ্যনুযায়ী করি- বপন করি গাছের চারা-বাঁচাই মানুষ সেবক যারা...
লেখক : মোমিন মেহেদী; চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি