সরাইলে মসজিদভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম প্রকল্পে অনিয়ম ও লুটের অভিযোগ

এফএনএস (মাহবুব খান বাবুল; সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : : | প্রকাশ: ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৭:১৮ পিএম
সরাইলে মসজিদভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম প্রকল্পে অনিয়ম ও লুটের অভিযোগ

ব্যাপক অনিয়ম, দায়িত্বে ফাঁকি আর লুটপাটের মাধ্যমেই চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম। পিতার বদলে পুত্র, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, অফিসে না আসা, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, একই নামে দুটি কেন্দ্র, ১টি কেন্দ্রকে ২টি দেখানো ও বন্ধ কেন্দ্রের সম্মানি উত্তোলনের মত লুটপাট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। শিক্ষক পদের শর্ত মসজিদে নিয়োজিত ইমাম। ইমামতি চলে গেছে তারপরও উপঢোকনে ঠিকে আছে একাধিক ব্যক্তির চাকরি। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের কাছ থেকে কৌশলে মারিংকাটিং এর বিষয়টি চাউর রয়েছে শুরূ থেকেই। ৩ কর্মকর্তার নিয়মিত অনুপস্থিতিতে উপজেলার প্রধান কার্যালয়টি অধিকাংশ সময় থাকে তালাবদ্ধ। গায়েবী সভা দেখিয়ে রেজুলেশন তৈরী ও স্বাক্ষর আদায় যেন মামুলি বিষয়। অফিসের অনিয়মের প্রভাবে মাঠের প্রতিটি কেন্দ্রেই চলছে শুধু লুটপাট। কাগজ ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন।  সরজমিন অনুসন্ধান ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই প্রকল্পে সরাইলে প্রাক-প্রাথমিক, কোরআন শিক্ষা ও বয়স্ক বিভাগ চালু রয়েছে। গত ৫ ফেব্রূয়ারি বুধবার দুপুর ১টায় উপজেলা সদরের প্রধান কার্যালয়ে (নতুন অফিস) গিয়ে দেখা যায়  সকল কক্ষেই ঝুলছে তারা। তিনজন কর্মকর্তার একজনও নেই দপ্তরে। মডেল কেয়ারটেকারের চেয়ারে বসে মুঠোফোন টিপছেন রেজাউল করিম নামের এক কলেজ শিক্ষার্থী। গণমাধ্যম কর্মীর উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রূত চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে পড়েন রেজাউল। রেজাউল বলেন, আমার পিতা জসিম উদ্দিন জরূরী কাজে এক জায়গায় গেছেন। আমি আপাতত আছি। আমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র। অথচ একই সময়ে জেলা প্রশাসক মো. দিদারূল আলম সহকারি কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় পরিদর্শন করছিলেন। জসিম উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া বেগমও কালিকচ্ছ কেন্দ্রের শিক্ষক। সরাইল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে এই প্রকল্পে মোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৮২ টি। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ৮৭ টি, সহজ কোরআন শিক্ষা ৯৪টি ও বয়স্ক শিক্ষা ১টি।  প্রত্যেক কেন্দ্রে নিয়োগ দিয়েছেন ১ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা। তাদের মাসিক সম্মানি ৫ হাজার টাকা। অফিসের তিন কর্মকর্তাসহ মাসিক মোট সম্মানি ৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।  দূর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। স্বামী স্ত্রীর প্রধান্য রয়েছে নিয়োগ পক্রিয়ায়। পাঠদানের নিয়ম ও সময় মানছেন না অধিকাংশ শিক্ষক। কারণ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও এই কেন্দ্রের হাজিরা দেখিয়ে লুটছেন সম্মানি। সরাইল সদরের ‘ছোট গুনারা জামে মসজিদ’ কেন্দ্রের শিক্ষক দাখিল পাস শেখ ফরিদ। শেখ ফরিদের সনদের বিরূদ্ধে দুইবার অভিযোগ উঠলেও রহস্যজনক কারণে এখনো আছেন বহালতবিয়তে। বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৮ টায় দেখা যায় ওই কেন্দ্রে নেই কোন শিক্ষার্থী। পাশের সড়কে দাঁড়িয়ে সূর্যের তাপ নিচ্ছেন শিক্ষক শেখ ফরিদ। বলছেন শিক্ষার্থী আসবে। আধা ঘন্টা অপেক্ষার পরও দেখা মিলেনি কোন শিক্ষার্থীর। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন এ ভাবেই চলছে। সনদে সমস্যা সৃষ্টির কথা স্বীকার করে পোনে ৯টার দিকে শেখ ফরিদ বলেন, স্যার শিক্ষার্থীরা এক সময় আসবে। সরাইল সদরের নান্নু ক্বারীর বাড়ির ‘শাহে মদিনা মক্তব’ নামের কেন্দ্রের শিক্ষক চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে গেছেন। তারপরও বহালতবিয়তে গায়েবী ভাবে চলছে ওই কেন্দ্রটি। সকাল সোয়া ৯টার দিকে চুন্টায় গিয়ে দেখা যায় ‘চুন্টা উত্তর পাড়া মসজিদ’ একই নামে চলছে দুটি কেন্দ্র। একটি মসজিদে। আরেকটি বাড়িতে। দুটির কোনটিতেই নেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। দুই কেন্দ্রের শিক্ষক স্বামী মো. দ্বীন ইসলাম ও স্ত্রী তৌহিদা আক্তার। দ্বীন ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, আমি কেন্দ্রেই আছি। কোথায়? আমি তো কেন্দ্রে কাউকে দেখছি না। স্যার আমি আসছি। বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র খালি পায়ে পাঞ্জাবী হাতে দৌঁড়ে আসেন দ্বীন ইসলাম। আপনার স্ত্রীর কেন্দ্রটি কোথায়? ইশারায় একটি ঘর দেখিয়ে ছোট ছোট কয়েকটি বাচ্চাকে টেনে আনার চেষ্টা করেন তিনি। ওই কেন্দ্রের শিক্ষিকা তৌহিদার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটিকে ভূয়া বলছেন অনেকেই। কালিকচ্ছ ইউনিয়নের কাবিতারা মসজিদের ইমাম মো. আবুল হোসেন চলে গেছেন ৫-৬ মাস আগে। ফলে সেখানে কেন্দ্রের কোন অস্তিত্বই নেই। অথচ এখনো উত্তোলন হচ্ছে ওই কেন্দ্রের সম্মানি।  পাকশিমুল ইউনিয়নের কালিশিমুল গ্রামের মাহমুদা আক্তার। তিনি শ্বশুরের নামে ‘কালিশিমুল মাতাব উল্লাহর বাড়ি’ কেন্দ্রের শিক্ষক। একই নামে মাহমুদা দুটি কেন্দ্র দেখিয়ে সম্মানি তুলছেন। শাহজাদাপুর ইউনিয়নের শাহজাদাপুর গ্রামে ‘দীঘির পুর্বপাড় মসজিদ’ নামের কেন্দ্রের শিক্ষক ওই মসজিদের ইমাম কুতুব শাহ। কুতুব শাহ’র চাকরি চলে গেছে অনেক আগেই। এখনো তার বাড়ির কাছে মসজিদে মক্তব দেখিয়ে সম্মানি নিচ্ছেন। একই ইউনিয়নের ‘গাজীপুর পশ্চিম পাড়া মক্তব’ কেন্দ্রের শিক্ষক স্বামী সিলেটের মাহমুদুল হাসান। ওই কেন্দ্রেও গতকাল সকালে গিয়ে দেখা মিলেনি কোন শিক্ষার্থীর। তার স্ত্রী সোনিয়া আক্তারের বাবার বাড়িতে ‘শাহজাদাপুর পূর্বপাড়া মক্তব’ নামের প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সম্মানির টাকা নিচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, কোন কেন্দ্র ও বাচ্চাদের পড়া লেখা নেই। মাস শেষে শুধু টাকাটা লুপাটের একটি পক্রিয়া এটি। উপরে যারা আছেন তাদেরকে মাল দিয়েই তারা অপকর্ম করছে। ভারপ্রাপ্ত মডেল কেয়ারটেকার মো. জসিম উদ্দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩/৪ টা পর্যন্ত নুরূর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও বিকাল ৩টা থেকে ৪/৫ টা পর্যন্ত কালিকচ্ছ এম বাশারে খন্ডকালীন কাজ করার কথা স্বীকার করে বলেন, সকালে পরিদর্শন শেষ করে ছেলেকে অফিসে দিয়ে যায়। ভারপ্রাপ্তের অতিরিক্ত দায়িত্বটা আমি নিতে চাইনি। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানতে হয়েছে। প্রকল্পের উপজেলা ফিল্ড অফিসার মো. আনিছুর রহমান বলেন, আমরা ফিল্ডে পরিদর্শনে থাকি। অফিসে কম থাকি। আমি সমন্বয় সভায় শিক্ষকদের সতর্ক করে থাকি। এখন থেকে অনিয়ম পেলে কেন্দ্র গুলি বাতিল করে দিব। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসেন বলেন, এই প্রকল্পের অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত অথবা খুঁজ খবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে