প্রতিবন্ধী তৌহিদুলের নার্সারিতে ভাগ্যবদল, মাসে আয় ৭০ হাজার

মো: হেলাল উদ্দীন; বাগমারা, রাজশাহী : | প্রকাশ: ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৫:০৩ পিএম
প্রতিবন্ধী তৌহিদুলের নার্সারিতে ভাগ্যবদল, মাসে আয় ৭০ হাজার

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে সৈনিক পদে চাকরি হয় তৌহিদুল ইসলাম বিপ্লবের (৩২)। সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট মামার মোটরসাইকেলে করে চাকরিতে যোগ দিতে রাজশাহীতে যাচ্ছিলেন। পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান মামা। গুরুতর অবস্থায় তৌহিদুলকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর বেঁচে ফিরলেও ডান পা অচল হওয়ায় চাকরিতে যোগ দেওয়া হয়নি। তৌহিদুল ভেবেছিলেন, তাঁকে পরিবারের বোঝা হয়ে বাঁচতে হবে। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে থেমে থাকেননি তিনি। এখন নার্সারিতে চারার ব্যবসা করে মাসে আয় করছেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। পরিবারে সচ্ছলতা আনার পাশাপাশি ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের তৌহিদুল। বাবা মোজাম্মেল হকের নার্সারির ব্যবসা ছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় হওয়ায় ছোটকাল থেকে বাবাকে সহযোগিতা করতেন নার্সারিতে। গাছের পরিচর্যাসহ ছোটখাটো কাজ করতেন। পাশাপাশি লেখাপড়া করতেন। মামা আনোয়ার হোসেন সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। ২০১২ সালে সেই স্বপ্নের কাছাকাছি গিয়েও পূরণ হয়নি। তৌহিদুল জানান, ২০১২ সালে চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েন। সেই দিনের কথা মনে হলে এখনো আঁতকে ওঠেন। মামা মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। ১৩ দিন পর চেতনা ফিরে পেয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালে। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও পায়ের সমস্যা থেকে যায়। ভেঙে যাওয়া পায়ে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেন না। ডান পা ভাঁজ করতে পারেন না। প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরে মনোবল শক্ত করেন। বাবার সঙ্গে নার্সারিতে সময় দেন। পাশাপাশি আবার লেখাপড়া শুরু করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন ২০২২ সালে। তৌহিদুল আরও বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার নার্সারির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হলেও যোগ দেননি। আট বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর (বাবার) পেশাকে ধরে রাখেন। পরিবারেরও হাল ধরার পাশাপাশি নার্সারির পুরো দায়িত্ব নিতে হয়। বাবার রেখে যাওয়া নার্সারির পরিসর ও আয় বাড়িয়েছেন কয়েক গুণ। সরেজমিনে মাড়িয়া গ্রামে তৌহিদুলের নার্সারিতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি চারার পরিচর্যা করছেন। পানি ছেটাচ্ছেন। সঙ্গে আছেন দুজন শ্রমিক। ফুলে ফুলে ভরে তুলেছেন নার্সারি। প্রায় তিন বিঘা জমির নার্সারিতে বিভিন্ন ফুল, সবজি, ফলজ, বনজ গাছের চারা দেখা যায়। তৌহিদুল জানান, নিজেই নার্সারিতে অধিকাংশ গাছের চারা তৈরি করেন। বাবার কাছ থেকে হাতে-কলমে ও পরে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে চারা তৈরি করা শিখেছেন। এ ছাড়া অন্য জায়গা থেকে চারা কিনে এনেও বিক্রি করেন। নার্সারি থেকে সরাসরি ও এলাকার বিভিন্ন হাটবাজার, মেলা ও ইসলামি জলসায় দোকান বসিয়ে চারা বিক্রি করেন। শ্রমিকসহ নানা ধরনের খরচ বাদে মাসে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হয় তৌহিদুলের। এ টাকায় ছোট ভাইকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। একটি পাকা নতুন বাড়ি নির্মাণ করার পাশাপাশি কিছু জমিও কিনেছেন। নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কয়েকজনকে কাজের সুযোগ দিয়েছেন। তৌহিদুলের মা তৌফিকা খাতুন বলেন, সংসারে আগে অভাব থাকলেও এখন ভালোভাবে চলছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে সংসারের হাল ধরেছেন। নার্সারির ব্যবসার পাশাপাশি লেখাপড়া শেষও করেছেন। মাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবন্ধী হওয়ার পর তাঁরা ভেবেছিলেন, তৌহিদুল পরিবারের বোঝা হয়ে গেলেন। তবে এ ধারণা পাল্টে দিয়ে তিনি একজন সফল নার্সারি ব্যবসায়ী হয়েছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে কীভাবে সফল হওয়া যায়, তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৌহিদুল। তাঁকে উৎসাহিত করতে স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁকে অনুসরণ করে অন্যদের এ পেশায় আসা উচিত।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে