সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই মূকাভিনয়ের উৎপত্তি। কারণ পৃথিবীতে মানুষ যখন প্রথম ভূমিষ্ট হলো, তখন মানুষের কোন ভাষা ছিল না। হয়তো শব্দ উচ্চারনের ক্ষমতা তার ছিল, কিন্তু সেই শব্দ ভাষায় প্রয়োগ করার ক্ষমতা মোটেই ছিল না। মানুষ তখন নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গির দারা একের ভাষা অপরকে বোঝাতে চেষ্টা করতো। মনের ভাব প্রকাশ করতো হাত নেড়ে ও চোখের ইশারায়।
তখন নানা মানসিক ভাবাবেগ বা অবস্থা যথা: ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা, আবেগ, যন্ত্রণা, উল্লাস, ব্যঙ্গ,রাগ, ঘৃণা ইত্যাদি পূর্বে মানুষ চোখের ভাষায় প্রকাশ করতো। এই ভাষাটা হলো মূক ভাষার। মূক ভাষার প্রতিশব্দ হলো Gesture, এটা লাতিন Gevtus থেকে এসেছে। Gestus হচ্ছে To move or to act, to convey a feeling or a mimetic expression through the action of head and eyes. এই যদি হয় Gesture language এর Definition, তাহলে বলতে হবে এটা প্রাচীনতম মূকাভিনয় কেই বলা হচ্ছে। Mime হচ্ছে ফরাসী শব্দ। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে Gesture language কে modify করে সুন্দর করা হলো। এই ভাবে modify হতে হতে যেটা দাঁড়ায় সেটাই হলো Performing Arts ( Acting and Dancing)।
খৃষ্টিয় সপ্তম ও অষ্টম শতকে ’বুদ্ধেও নাটক’ নামে এক প্রকার নাটক প্রচলিত ছিল, যাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে বুদ্ধের নীতি, রীতি এবং আদর্শ দর্শকদেও সামনে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে প্রচার করতো।
মৌন অভিব্যক্তির দ্বারা মানুষের অন্তরের আবেগ ও উৎকন্ঠা, সুখ,দুঃখ, উল্লাস ও আতংককে জীবন্ত করে তোলার এবং শুধুমাত্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিঃশব্দ সঞ্চালনের দ্বারা গতিশীল জীবনের কোন রুপ ও আকার ফুটিয়ে তোলার যে শিল্পকৌশল তাকেই বলে mime বা মূকাভিনয়। সাধারণত ব্যালের সঙ্গে এই মূকাভিনয়ের অবিচ্ছেদ্য যোগ আছে। চলচ্চিত্রের প্রথম যুগের এই মূকাভিনয়ের মাধ্যম ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আইজেনষ্টাইনের ’ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ ’অক্টোবর’ কিংবা ষ্ট্রাইক অবিস্মরণীয় নির্বাক সৃষ্টি। আর এ কালের মহৎ শিল্পী চার্লি চ্যাপলিন যিনি নীরব ভাষার কথায় আমাদেও হাসি-কান্নায় ভরিয়ে রাখতেন। আমরা যে অভিনয় করি তা মানুষের জীবনকে চিত্রিত করি মঞ্চে। আমরা একটা দৃশ্যকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে অভিনেতাদের দিয়ে মঞ্চে বিন্যাস করি, ছবি তৈরি করি, গতিসঞ্চার করি, একটা ছন্দে বাঁধবার চেষ্টা করি। সেই সঙ্গে মূক নাট্যায়নও করতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ দেখার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয়-শোনা অপেক্ষা। এই সত্যটাকে নাট্যানুষ্ঠানে মনে রাখতেই হয়। সাধারণভাবে প্যানটোমাইম Pantomime বলতে আমারা বুঝি- বাক্য ব্যাবহার না করে ক্রিয়া। মঞ্চাভিনয়ে এই ক্রিয়া হল মুখের বিভিন্ন অভিব্যাক্তি, শরিরের বিভিন্ন ভঙ্গি এবং মঞ্চে গতিসঞ্চার। এসবই আহরণ করা হয় জীবন থেকে। অভিনীত চরিত্রের বৈষিষ্ট তার অবস্থা, সময় এবং পরিপাশর্^ বোঝাবার জন্যই এসব করা হয়। সংলাপ ব্যতিরেকে যদি এই ক্রিয়া দ্বারা সে প্রকাশ পায় তাহলে সেই ক্রিয়া মূক অভিনয়। আমরা সিগারেট ধরাই, আমরা তাক থেকে বই নামিয়ে পড়তে বসি, বিছানার চাদর কিংবা আলনায় কাপড় গুছিয়ে রাখি, জানালা বন্ধ করি মঞ্চে। এগুলো মূক ক্রিয়া। কিন্তু কোন চরিত্র কী অবস্থায় সে কাজগুলো করছে সেটা আলাদা আলাদাভাবেই প্রকাশ করতে হয়।
মানুষের গতি বা চলা, হাঁটা, বলা সবটাই তার প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়। আমি পোশাকের আলমারী খুলতে যাচ্ছি কিংবা রান্নাঘরের মিটসেফ খুলতে যাচ্ছি, এ যাওয়ার উদ্দেশ্য দু’ রকম- তাই যাওয়াটাও আলাদা হবে। ক্ষুধার্ত ছেলেটি মিটসেফ খুলতে পারে আবার এক লোভী ছেলে মিটসেফ খুলতে পারে দু’ক্ষেত্রে মূক নাট্যায়ন দু’রকম হবে। দর্শক যেন বুঝতে পারে এই দুই ভিন্ন উদ্দেশ্য। সাধারণ নাচে যে মুদ্রা ব্যবহার হয় সেই মুদ্রার ভাব ও ভঙ্গি বুঝতে হলে সেই মুদ্রার আলফা বিটা জানা প্রয়োজন। তা না হলে মুদ্রার অর্থ বোঝা যায় না। কিন্তু মূকাভিনয়ে যে মুদ্রা ব্যবহার হয় সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে ও সচরাচর আমরা যেভাবে বাস্তবে হাত-পা সঞ্চালন করি ঠিক সেভাবেই করা হয়। বিশেষ করে ইলিউসানের (illusion) দিকে নজর রাখা হয় যাতে করে সমস্ত ব্যাপারটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। মূকাভিনয়ের কাহিনীবস্তুর মুহূর্তটিকে ঠিকভাবে জীবন্ত করে তুলতে হবে।
illusion গুলোকে জানতে হবে অঙ্গভঙ্গি সঞ্চালনের দ্বারা যাতে করে requisition, set-setting-এর কোন রকম অভাব দর্শক অনুভব না করতে পারে। সমস্ত ঘটনাটি জীবন্ত হতে হবে অঙ্গ সঞ্চালনের দ্বারা। মনে রাখতে হবে illusion না আসা পর্যন্ত মূকাভিনয় শিল্পের সৃষ্টি হয় না। বর্তমানে আমাদের দেশে পার্থ প্রতিম মজুমদার, জিল্লুর রহমান জন, সাইফউদ্দিন শোভন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন খুব বেশী করে। তাই বিদগ্ধজনদের প্রতি আহ্বান এর প্রচার এবং প্রসারে ব্যাপক উৎসাহ, সহায়তা এবং সাহায্য প্রদান জরুরী হয়ে পড়েছে।
লেখক: মূকাভিনয় শিল্পী। বাংলাদেশ মাইম এন্ড ফিজিক্যাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।