একযুগ আগে নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের একটি নাটকে কমিডিয়ান ডা: এজাজুল ইসলাম একটি ডায়ালগ ছিলো এমন- “আমার বড় নইজ্জা লাগে”। চরিত্রের মানুষটি নানা অসঙ্গতি আর ঝামেলায় পরলেই বলতেন তার এ লজ্জার কথা। দেশের মানুষ এখন বড় নিষ্ঠুর হয়ে পরেছে। খুনখারাবি হচ্ছে পথে ঘাটে। গুজবে কান দিচ্ছে মানুষ। গনপিটুনি দিয়ে নিরিহ মানুষ মারছে মানুষকে। সমাজে মূর্খতা বেড়েছে। ধারাবাহিকভাবে এমন কান্ড দেখে অভিনেতা এজাজের মতো ও আমাদেরও বড় লজ্জা লাগে।
আমরা হুজুগে বাঙ্গাল। কান চিলে নিয়েছে কেউ বলেছেতো, তার পিছু ছুটছিতো ছুটছিই। হাল সময়ে ‘ফেসবুক’ হুজুগে আগুন লাগিয়েছে। কেউ একজন কিছু একটা লেখেছেতো দেশ শুদ্ধ হৈ-চৈ শুরু হয়ে যায়। পদ্মা সেতুতে নাকি রক্ত আর কল্লা (মাথা) লাগবে। এ থেকে আতংক; ছেলে ধরা আর গনপিটুনী। একি অবস্থা দেশে! চোখের সামনে নিরীহ মানুষ মরছে। বড় লজ্জা লাগে। এ আতংক দুর করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষারদের কাউন্সিলিংয়ের জন্য গিয়েছি। প্রতি জায়গাতেই আমি শিক্ষাদেও প্রশ্ন করেছিলাম- “তোমাদের কোন বন্ধু-বান্ধব, আতিœয়-স্বজনকে কি কোন ছেলে ধরা নিয়ে গেছে? কারো মাথা কেঁটে নিয়ে গেছে?” কেউই হ্যাঁ সুচক উত্তর দিতে পারেনি। বলেছিলাম- “তোমরা আধুনীক জুগে বাস করছ। গুজবে কান দিচ্ছি কেন?” আরও বলছিলাম-সেতু বানাতে কি মাথা রক্ত লাগে? উত্তরটা আমি নিজেই দিচ্ছিলাম, শিক্ষারদের বলছিলাম- “সেতুতে ভালোমানের রড লাগে, সিমেন্ট, বালু, কনক্রিটি লাগে। আর লাগে মানুষের মাথার ব্রেইন আর্থাৎ বুদ্ধ। আর কতক মানুষের ঘামঝড়া শ্রম লাগে। সেখানে রক্ত আর মানুষের মাথার কেন প্রয়োজন হবে? শিক্ষাদের বলেছি- এমন বাজে আতংকে, গুজবে তোমাদের শিক্ষা থমকে যাবে। তোমরা পড়াশুনায় পিছিয়ে যাবে। আর এটাই হয়তো চায় গুজব রটনাকারীরা। বলেছি তোমরা সর্বাধুনী জমানায় বাস করে এটা বিশ্বাস করবা কিনা? সবাই এক বাক্যে বলেছে “না”। যখন বুঝালাম তখন সবাই বুঝল। তাই এখানে এজাজ সাহেবের মতো আর লজ্জা পাচ্ছি না আমি। আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি, ওরা বুঝেছে। আমরা বাঙ্গালরিা যেমন সহজ সরল, সহসাই নেগেটিভ আবার পজেটিভও বটে! শুধু বুঝাতে হয়। আমারা যারা সচেতন মানুষ তাদের এই শিক্ষকতা কিংবা কাউন্সিলিংয়ের কাজটা করতে হবে সব সময়। তাহলে গুজবের গজব ছড়াতে পারবে না দুষ্টু চক্র।
গুজব মানেই কিন্তু মিথ্যা রটানো। সমাজে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এ গুজব। সেখাসে সত্য অসহায় হয়ে পরে। বর্তমানে নানা গুজবের ভয়াবহতায় সারা দেশের মানুষ আতংকে রয়েছে। দীর্ঘ হয়েছে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মিছিল আর গণপিটুনি। বাড্ডায় মেয়ের জন্য চিপস আনতে গিয়ে গনপিটুনিতে খুন হন। রেনু নামে এক গৃহবধু। নিহত রেনুর ছোট্ট মেয়ে তবা এখনো অপেক্ষা করে মায়ের জন্য। তার মমতাময়ী মা নাকি তার জন্য চিপস আনবে। সে আশায় এ ছোট্ট খুকুমণিটির অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। গণপিটুনিতে নির্মমভাবে নিহত তবার মা আর কখনই ফিরে আসবে না। তবাকে কি জবাব দেব আমরা? জবাব দেয়ার ভাসা আমাদেও নেই। এ জন্য আামরা বড়ই লজ্জিত।
নারায়ণগঞ্জে বাক প্রতিবন্ধী যুবক সিরাজকেও ওরা গণপিটুনি দিয়ে মেরেই ফেলল। প্রতিবন্ধি বলে সিরাজের বউ তার বড় আদুরে মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে বেশ ক’মাস আগে। প্রাণপ্রিয় মেয়েকে সিরাজ অনেক খুঁজেছে। মেয়েকে পায়নি। শেষতক খোঁজ পেল তার কলিজার টুকরো মেয়েটা নাকি নারায়ণগঞ্জে আছে। জানতে পেরেই সিরাজ আকুল হয়ে চিপস, পুতুলসহ তার মেয়েকে দেখতে নারায়নগঞ্জে আসে। পরের ঘটনাটা ঘটে খুবই ভয়ংকরভাবে। এই সিরাজকেও গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলল কটা অসভ্য খুনী মানুষ।
ওরা একদিন হয়তো আমাকেও মেরে ফেলতে পারে। এমনই গণপিটুনিতে হয়তো আমার প্রাণ বায়ুটা আর্তনাদ করতে করতে নীল আকাশে হারিয়ে যাবে। প্রতিবন্ধি সিরাজের মতো প্রমাণ হবে আমি ছেলেধরা নই। আমি পদ্মাসেতুর জন্য কারো কল্লা কাটতে আসিনি। ততদিনে আমার কবর রচিত হবে পারিবারিক কবরস্থানে। ছি: ছি: লজ্জায় মওে যাই আমরা। রড় বেশি লজ্জা পাই আমরা। প্রতিবন্ধি সিরাজেরও নিরাপত্তা নেই এেেদশে। আমরা গুম খুনের জন্য মাঝে মধ্যে সরকারকে দুষি। আমরা জনগনও কম কো থায়? গারা দেশে কতনা হত্যাকান্ড হচ্ছে। মানুষ মানুষকে খুন করছে। জমির জন্য অর্থেও জন্য নানা কারনে কথায় কথায় মানিুষ খুন হচ্ছে। লজ্জা বড় লজ্জা লাগে আমার ওসব ভেবে।
হুজুগের গজব বাংলাদেশে সব সময়ই দেখেছি। হুজুগের দাপটে হালসময়ে শেয়ার বাজারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেছে শেয়ার লুটেরারা। এদেশে এটা নতুন নয়। বারবরই ঘটছে। নিরিহমানুষ গুলো সর্বস্ব হারাচ্ছে। তবুও তারা হুজোগে আর লোভে শেয়ার বাজের ছোটে যাই বারবার। ওদের বলতে গেলে লজ্জা নেই। এখানেই আমার বড় লজ্জা লাগে।
হালে নতুন একটা গুজব ছড়ানো হয়েছে। ডেঙ্গু মশা মারতে শুক্রবার জুমার নামাজের পর নিজ নিজ বেসিন এক বোতল হারপিক, আর এক কেজি ব্লিচিং পাউডার ঢালার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। তাতে নাকি ডেঙ্গু মশার ডিম ও লার্ভা ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাবা কি যায় বিষয়টা কতটা ভয়ংকর! এভাবে সবাই যদি হারপিক আর ব্লিচিং পাউডার ছেড়ে দেয় ড্রেনে তাহলে পরিবেশের কি হবে? নদীতে গিয়েও এই ব্লিচিং আর হারপিকের বিষ গিয়ে পরবে। তখন পানিতে প্রাণের অস্তিত কি থাকবে? পাঠক আপনারাই বলুন ডেঙ্গু মশার ডিম কি ওসব ড্রেনে থাকে। ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার জন্ম নর্দমায় হয় না। বাড়ির পাশে পড়ে থাকা ডাবের খোঁসা, পলিথিন, টব এজাতিয় পাত্রে জমা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। না বুঝোই মানুষ হারপিক ব্লিচিং থিওরি ছড়াচ্ছে ফেসবুকে। মানুষের এমন মূর্খ আচরনে বড় লজ্জা লাগে।
গুজব ছড়ানো হলো বিদ্যুৎ নিয়ে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়াচ্ছে দেশে তিনদিন বিদ্যুৎ থাকবে না। তখন ছেলেধরার দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য কল্লা কেঁটে নিয়ে আসবে। এটা পুরোপুরি গুজব। এমর আধুনীক সময়ে বাস করেও এ গুজবে কান দিয়ে আমরা আতংকিত হচ্ছি। এমন লজ্জা কোথায় রাখি পাঠক আপনারাই বলেন।
এদেশে গুজব নিয়ে আবার রাজনীতিও হচ্ছে। সরকার কোন ব্যর্থতা ঢাকতে তা গুজব বলে চালিয়ে দিচ্ছে বলে দাবি করছে বিরোধী দলগুলো। তাঁরা কোনটা গুজব তা জাতির কাছে পরিষ্কার করতে বলেছেন সরকারকে। ডেঙ্গু বিস্তারের ঘটনা নাকি গুজব। শিশু নির্যাতন, শেয়ারবাজারে লুট, খুন গুম কোনটা গুজব জাতির কাছে পরিষ্কার কথা বলছে বিরোধীদলের নেতারা। কোন কিছু ঢাকতে তা গুজব বলে চালিয়ে দেওয়ার অভ্যাসও কিন্তু আমাদের আছে। এ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।
আগেও গুজবের গজব ছিলো। তখন তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তো না। আঞ্চলিক সীমানার মধ্যে থাকতো গুজব। আদুনীক এ জমানায় গুজবের ডালপালা মূহুর্তেও মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশ বিদেশে। গুজব ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই। অস্বীকার করা যাবে না যে, গুজব সব সমাজেই রয়েছে। বাংলাদেশেও এর শিকড় অনেক গভীরে বলেই 'চিলে কান নেওয়া' প্রবাদের জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষায়। রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ক্ষেত্রে গুজব কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, তার ভয়াবহ নজির সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি। আমাদের মনে আছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এক জামায়াত নেতাকে 'চাঁদে দেখা যাওয়ার' গুজব শুনে ২০১৩ সালে বগুড়া কীভাবে রক্তাক্ত ও বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছিল। তারও আগে, ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে গুজব ছড়িয়ে বৌদ্ধমন্দির ও বসতিতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। আর ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ২০১৭ সালে রংপুরে গুজব ছড়িয়ে হামলা চালানো হয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে। আমরা দেখেছি, এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। স্বীকার করতে হবে- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক অনেক অবদানও রয়েছে। পাশাপাশি অনেক ক্ষতিকর সাইডও আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের। এটি ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে মানুষকে যেমন কাছে এনে দিচ্ছে, তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা ইস্যুতে গড়ে তুলছে ইতিবাচক উদ্যোগ। যা কিনা খুনখারাবির দিকেও গাড়াচ্ছে।
গুজব এমন একটা বিষয় যা সহজেই রচনা ও রটনা করা যায়। একবার গুজব রটে গেলে তা সামাল দেয়া বড় কঠিন হয়ে পরে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। দেশের সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।জনগনকে রটনার বিরুদ্ধে বাস্তবটা বোঝাতে হবে। বড় কথা, কোনো খবর শোনামাত্রই যাচাই-বাছাই ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া কোন সুবিবেচনার পরিচয় হতে পারে না। গুজব রটনাকারীদেও বিরোদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। ওদেও চিহৃত কওে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা এবার দেখছি, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এ ধরনের গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।তারা জনগনকে বোঝানোর দ্বায়িত্বেও মাঠে নামে। তাতে করে পরিস্থিতি পুরটা সামাল দেয়া না গেলেও উন্নতি হয়েছে। আমরা আশা করি, এ ব্যাপারে আরও কঠোর হবে, এছাড়া জনগনও এসব দেখে ভবিষ্যতে গুজবের পথে না হেঁটে অধিক সাবধান ও সচেতন হবে।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিষ্ট, গবেষক।