ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে পৃথিবীতে উপনিবেশবাদের (কলোনিয়ালিজম) উদ্ভব। উপনিবেশ এমন একটি অঞ্চল, যে অঞ্চল এবং তার জনগণ অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসন ও শোষণের অধীন। উপনিবেশ স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ওই সমস্ত অঞ্চল থেকে কাঁচামাল ও অন্যান্য বহনযোগ্য সম্পদ লুন্ঠন করে নেওয়া। প্রকৃত অর্থে উপনিবেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকে না।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করতে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। তবে উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে উদ্ভুত হয় আরেক পন্থা, যার নাম। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করাই নব্য-উপনিবেশবাদ। নতুন হোক আর পুরনো হোক, উপনিবেশিকতা সম্পদ লুটের পার্শ্বক্রিয়া হিসেবে সংস্কৃতির ভেতরে ছড়িয়ে দেয় ভয়ের বীজ।
ভারতবর্ষ দীর্ঘ দুইশত বছর ছিল ব্রিটিশদের অধীনে। সেসময়কার শাসন ও শোষণের ইতিহাস থেকে জানা যায় তারা কীরকম নৃশংশভাবে মানুষকে দমিয়ে রেখেছিল। আর তাদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার ছিল এখানকারই একদল অধিবাসী, যারা ব্রিটিশদের সুবিধাভোগী ও আশীর্বাদপুষ্ট ছিল। এই বিশেষ শ্রেণি ছিল ‘এলিট’। এদেরকে সবাই সমীহ করে চলত এবং তারা তোষামদও কম পেতেন না।
তারপর, ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পর আরও চব্বিশ বছর এই দেশে চলে পাকিস্তানের নিপীড়ন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানিরা এদেশ থেকে চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু রেখে গেছে উপনিবেশবাদের কিছু নিদর্শন। তারই অন্যতম একটি হল ‘জ্বি হুজুর’ সংস্কৃতি।
বাঙলা ভাষায় সম্মতি জ্ঞাপনে সাধারণত ‘হ্যাঁ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বিকল্প হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীরা ‘আজ্ঞে’ শব্দটি ব্যবহার করত। যা ‘আজ্ঞা’ থেকে উৎপন্ন এবং মনিব বা উচ্চপদস্থদের সঙ্গে কথপোকথনে ব্যবহার করত নিম্নপদস্থরা। বাংলাদেশে ‘আজ্ঞে’র কোনও ব্যবহার নেই। এর পরিবর্তে এখানে ব্যবহৃত হয় ‘জ্বি’। পাকিস্তান আমলের ‘হুজুর’রা না থাকলেও এখন এই দেশে ‘স্যার’রা আছেন। ‘জ্বি হুজুর’র বদলে এখন চলে ‘জ্বি স্যার’।
এসব কথার অবতারণা যে কারণে তা হল, যশোরের অভয়নগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি চার সাংবাদিককে কার্যালয় থেকে বের করে দিয়েছেন। সাংবাদিকদের অভিযোগ, অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাসহ অনেক কর্মকর্তা নিয়মিত কার্যালয়ে আসেন না। ওই কার্যালয়ে গিয়ে কৃষি কর্মকর্তাকে না পেয়ে দু’জন সাংবাদিক কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। এ সময় তিনি দুই নারীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সাংবাদিক দু’জন তাঁকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে কৃষি কর্মকর্তা কোথায় আছেন তা জানতে চান। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে আসেন এবং কার্যালয়ের পিওনকে ডেকে দু’জনকে বের করে দিতে বলেন। এ ঘটনার পর আরও দু’জন সাংবাদিক বিষয়টি জানতে ওই কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। এ সময় তাঁরা তাঁকে ‘ভাই’ বললে তাঁদেরও তিনি কার্যালয় থেকে বের করে দেন। এসময় ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি একজন বিসিএস ক্যাডার। আমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না? আমাকে স্যার বলতে হবে।’
শুধু যশোরের এই ঘটনাই নয়, এমন ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে অহরহই ঘটে থাকে এবং অনেকক্ষেত্রে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। সাংবিধানিকভাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা জনগণের সেবক। প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ছড়ি ঘুরিয়ে শাসন করা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আইন এবং সংবিধানের বিধি-নিষেধের প্রতিপালন নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠানিকভাবে পদস্থদের ‘স্যার/ ম্যাডাম’ সম্বোধনের বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রের একজন নাগরিক তাঁর সেবাদানকারীকে বাধ্যতামূলকভাবে ‘স্যার’ বলবেন তার নির্দেশনা কোথায় আছে? আর ‘স্যার’ না বললে দুর্ব্যববহার করার অধিকার কোথায় পান?
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের পাশাপাশি অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতির খবর প্রায়ই শোনা যায়। মূলত লুটপাট ও কুকীর্তিকে ঢাকতে প্রয়োজন হয় দাপটের। আর জনগণকে যতটা দূরে রাখা যায় ততটাই মঙ্গল। এজন্য সহজাত শ্রদ্ধার চেয়ে ভীতিমূলক ও জবরদস্তিমূলকভাবে সম্মান অর্জনের চর্চা বেশি। এর সাথে রয়েছে ‘মুই কী হনুরে’ জাতীয় অহংকার। একজন কর্মকার্তা যখন তাঁর চেয়ারে বসেন, তখন তিনি ভুলে যান যান যে একজন সাধারণ কৃষক বা শ্রমিকের টাকায় তিনি আয়েশ করছেন। অথবা ভুলে না গেলেও তিনি এই ‘ছোট হওয়াকে’ মানতে পারেন না কারণ ঔপনিবেশকালের কিছু খেতাবকে আমলাতান্ত্রিক মানসিকতায় ধরে রেখেছেন। আর শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বেসরকারি অফিসগুলোতেও এটি প্রচলিত।
প্রশ্ন আসতে পারে, স্যার না বললে কী বলে সম্বোধন করা হবে? বাঙলিরা নামের আগে-পরে হিন্দুদের ক্ষেত্রে শ্রী/ শ্রীমান-শ্রীমতি/ দেবী/ বাবু আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে জনাব/ জনাবা/ সাহেব ইত্যাদি অনেক আগের থেকেই ব্যবহার করে আসছেন। ইংরেজিভাষীরা নামের আগে মিস্টার/ মিসেস অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেবল নামটাই ব্যবহার করেন। বয়সে বেশি হলেও কোনও সমস্যা নয় এবং এতে কারও সম্মানহানি ঘটে না। এমনকি উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের যেমন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে পদবি অনুযায়ী মিস্টার/মিসেস প্রসিডেন্ট বা মিস প্রাইম-মিনিস্টার সম্বোধন করা হয়। এতে তাদের কিছু এসে যায় না, কারণ নামটাই ব্যক্তির আসল আইডেন্টিটি।
অথচ আমাদের দেশে 'স্যার' সামাজিক মর্যাদায় একটি বিষয়। এছাড়া যিনি অপরকে 'স্যার' বলবেন তিনি নিজেকে আরেকজনের চেয়ে 'ছোট' ভাবতে চান না তথা সামাজিক স্তর বিভাজনে বিভক্ত হতে চান না। অর্থাৎ তিনি 'উপনিবেশ বিরোধী মনোভাবাপন্ন'। তার মানে এদেশ থেকে বৃটেন গেছে, পাকিস্তান গেছে কিন্তু উপনিবেশবাদ এখনও যায়নি। অপরদিকে নাগরিকদের স্বাধীনতা এখনও কৌশলে বন্দি। নব্য-উপনিবেশবাদের সাথে তাল মিলিয়ে এখনও এই সমাজে চলছে পুরনো উপনিবেশের জিনগত রূপান্তর - ‘আধুনিক উপনিবেশবাদ। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘স্যার’দের এই উপনিবেশ থেকে জনগণ মুক্ত হবে কবে?