সারাবিশ্বের পর্যটকরা প্যারিস ভ্রমণের সময় যে ক’টি স্থাপনার দিকে বিশেষ নজর রাখেন, সেই নতর-দাম ক্যাথেড্রাল পুড়ল আগুনে। ফ্রান্সের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলের এই ‘আইকনিক’ স্থাপনায় গতকাল বিকালে আকস্মিকভাবে অগ্নিকা- ঘটে। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়ে আটশ বছর পুরনো এই গির্জা ভবনে অগ্নি এবং ধোঁয়া ওড়ার ছবি ও ভিডিও সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৬টায় অগ্নি লাগার পর তা দ্রুত কাঠের গড়ন ও জানালাগুলো পুড়িয়ে মূল গির্জার গম্বুজাকৃতির ছাদে ছড়িয়ে পড়ে। ইয়াসেক পোলতারাক নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী রয়টার্সকে বলেন, “পুরো ছাদই ধসে পড়েছে, বলা যায়, এই ভবনের আর কোনো আশা নেই।” ‘সব কিছুই ধসে পড়ছে,” ছাঁদ আগুনে পুড়তে দেখে বলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। বিবিসি জানিয়েছে, ছয় ঘণ্টার আগুনে এই চার্চের ছাঁদ ও পিরামিড সদৃশ কাঠামোর প্রায় পুরোটা ধসে গেলেও পাথরে নির্মিত মূল গড়ন ও ঘণ্টার দুটি টাওয়ার রক্ষা করতে পেরেছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর সদস্যরা অগ্নি নেভাতে সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়লেও অবস্থা বুঝে তারা গুরুত্ব দেন মধ্যযুগে নির্মিত এই স্থাপনার ভেতরে থাকা অমূল্য সব শিল্পকর্ম রক্ষায়।
প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগোকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, গির্জায় থাকা মূল্যবান চিত্রকর্মগুলো রক্ষা সাধন গেছে এবং তা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। খ্রিস্টানদের পাশে মহাপবিত্র ‘ক্রাউন অব থর্নস’ রক্ষা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন এই চার্চের প্রধান মঁসিনিয়র প্যাত্রিক শুভে। খ্রিস্টান ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার সময় তার মাথায় এই কাঁটা মুকুটটি ছিল। ফরাসি স¤্রাট নবম লুই বায়েজেনটাইন স¤্রাটের নিকট থেকে এটি উপহার পান দ্বাদশ শতকে। প্যাত্রিক শুভে বলেছেন, মূল্যবান শিল্পকর্মগুলো রক্ষায় অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর সদস্যদের প্রাণান্ত খাটতে হয়েছে। এই অগ্নি নেভাতে গিয়ে অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর একজন সদস্যের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সংবাদ দিয়েছে রয়টার্স। অগ্নিকা-ে এটাই আহতের একমাত্র ঘটনা। কীভাবে অগ্নি লাগল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ভবন সংস্কারের সময় কোনো গোলযোগ থেকে এই আগুনের সূত্রপাত বলে ফরাসি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বিবিসি জানিয়েছে। প্যারিস প্রসিকিউটর অফিস জানিয়েছে, কীভাবে অগ্নি লাগল, তার তদন্ত শুরু করেছেন তারা। এক পুলিশ কাজের ব্যাপারে প্রধান ব্যক্তি রয়টার্সকে বলেন, এই অগ্নিকা-কে দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছেন তারা। আগুন লাগার সংবাদ শুনেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তার জাতির উদ্দেশে ভাষণ স্থগিত করেন বলে এলিজে প্রসাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। পরে তিনি ঘটনাস্থলেও ছুটে যান; নিরুপায় দৃষ্টিতে নতর-দাম ক্যাথেড্রাল পুড়ে যাওয়া দেখেন তিনি, যার দৃষ্টিতে এটি ‘ভয়াবহ ট্রাজেডি’। শোকাহত প্যারিসবাসীকে তিনি আশ্বাস দেন ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীকটি পুনর্নিমাণের। ম্যাক্রোঁ সাংবাদিকদের বলেন, “সবচাইতে মন্দ পরিণতি (পুরো ধসে পড়া) এড়ানো গেছে। আমরা সবাই মিলে এটি পুনরায় গড়ে তুলব। এটাই এখন আমাদের গন্তব্য এবং আগামি দিনগুলোতে আমাদের পেশা হবে এটাই। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর সদস্যরা পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোপুরি নেভাতে। তাদের কাজে কোনো ধরনের বিঘœ যেন না ঘটে, সে দিকে দৃষ্টি রাখতে নাগরিকদের পরামর্শ দিয়েছেন মেয়র অ্যান হিদালগো। তিনি একে ‘ভয়ানক অগ্নিকা-’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, অগ্নি নির্বাপক বাহিনী ভবনটি ঘিরে যে সতর্কতামূলক বেষ্টনি তৈরি করেছেন, নাগরিকরা যেন নিরাপত্তার স্বার্থে তার বাইরে অবস্থান করেন। কর্মকর্তারা বলেছেন, প্যারিসের কেন্দ্রস্থলের সেইন নদীর মধ্যকার দ্বীপের এই গির্জার আশপাশের ভবনগুলো নিরাপত্তার স্বার্থে শূন্য করে ফেলা হয়েছে। নিরাপত্তা বেষ্টনির বাইরে থেকেই নতর-দাম ক্যাথেড্রাল পুড়ে যাওয়া দেখেন প্যারিসবাসী; তাদের কারও চোখে ছিল জল, কেউ বা করছিলেন প্রার্থনা।
আইফেল টাওয়ার ও লুভর জাদুঘরের পাশাপাশি প্যারিসে আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকা নতর-দাম ক্যাথেড্রাল প্রতি বছর দেড় কোটি পর্যটকের স্পর্শ যায়, যা নিয়ে গর্ব করে ফরাসিরা। ফ্রান্সের এই নতর-দাম ক্যাথিড্রালে উদ্বেগ ছড়িয়েছে বিশ্বনেতাদের মধ্যেও; নানা পরামর্শও দিচ্ছেন তারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প অগ্নি লাগার সংবাদ শুনেই তা নেভাতে ‘ফ্লাইং ওয়াটার ট্যাংকার’ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল শোক জানিয়ে বলেন, এটা শুধু ফ্রান্সই নয়, ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতীক। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে বলেন, তিনি ফরাসিদের সঙ্গে সমব্যথী। সারাবিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান প্রধান স্থান ভ্যাটিকান নতর-দাম ক্যাথেড্রালকে ফ্রান্স ও পৃথিবীর খ্রিস্টানত্বের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করে এতে অগ্নিকা-ে ভারাক্রান্ত হওয়ার উক্তি জানিয়েছে।
খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে শুরু হয়েছিল নতর-দাম ক্যাথেড্রালের নির্মাণ, একশ বছর লেগেছিল এই পেশা শেষ করতে। তারপর কয়েক বার এর সংস্কার হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময় এই ক্যাথেড্রাল যার ক্ষতি হয়েছে এমন হয়ে দীন-হীন হয়ে পড়েছিল। অথচ ভিক্তর উগোর জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস হ্যাঞ্চব্যাক অফ নতরদাম বা নতরদামের মুটির কলসি প্রকাশিত হওয়ার পর সবাই নতুন করে আবিষ্কার করে এই গির্জাকে। এরপর এটি সংস্কারে বড় উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৮৪৫ সালে, ২৫ বছর কাজের পর পুনরায় দৃষ্টিনন্দন অবস্থায় ফেরে ইউরোপে মধ্যযুগের শেষার্ধ্বের গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনা। তবে কিছুকাল সামনে ভবনের বিভিন্ন অংশের পাথরে ফাটল ধরায় শঙ্কা তৈরি হয় ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য এই ভবনটি নিয়ে। অগ্নিকা-ের ২৪ ঘণ্টা সামনে নতর-দাম ক্যাথেড্রালে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি পর্যটক জাহিন শাহরাত ইসলাম, গির্জার ভেতরের এই ছবিও তোলেন তিনি অগ্নিকা-ের ২৪ ঘণ্টা সামনে নতর-দাম ক্যাথেড্রালে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি পর্যটক জাহিন শাহরাত ইসলাম, গির্জার ভেতরের এই ছবিও তোলেন তিনি গত বছর ফ্রান্সের কাথলিক চার্চগুলো নতর-দাম কাথেড্রাল রক্ষায় তহবিল যোগাতে ফ্রান্সের সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় সংস্কার কাজ, সেই সংস্কার কাজই ভবনটি বিলীন করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখল বলে এখন মনে সাধন হচ্ছে।