পৃথিবীতে যে মা দশ মাস দশ দিন ধরে যাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, আবার মহা কষ্টেরও তীব্রতা সয়েছেন। তিল তিল করে বড় করে তুলছিলেন সেই প্রিয় সন্তানকে। ওই সন্তানরাই কখনো ছুরি হাতে, কখনো ক্ষুর হাতে তেড়ে আসছে পিতা-মাতার দিকে। বড়ই দুঃখজনক ঘটনা। কোনো না কোনো বাড়িতে নিত্যদিন চলছে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা। নেশার টাকা না পেয়ে পিতা-মাতাকে হত্যা করছেন সন্তানরা। সন্তানের এমন অচেনা রূপের কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, ইয়াবায় আসক্তরা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এভাবে নিষ্ঠুর নির্মম হয়ে যায়।
একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি চট্টগ্রামের কোতোয়ালী এলাকায় এমন ধরনের দুটি ঘটনাও ঘটেছে। একটিতে সন্তানতুল্য ভাগ্নে ইয়াবা কেনার টাকা না পেয়ে মামীকে খুন করেছেন। অন্যটিতে সন্তান নিজেই খুন করেছেন তার পিতাকে। বাকলিয়া থানা এলাকায় ইয়াবা আসক্ত সন্তান দুই দুইবার পিতাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। সৌভাগ্যজনকভাবে সন্তানের মা, ভাই ও পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন থানায় প্রতিনিয়ত পিতা-মাতারা আসছেন ইয়াবা আসক্ত সন্তানের হাত থেকে নিজেদের রক্ষায় আইনের আশ্রয় নিতে। অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স, বিউটিশিয়ান ও শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ। বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজামউদ্দিন বলেন, গত ৪মে স্বামীকে হত্যাচেষ্টার দায়ে মাদকাসক্ত সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করেন মা হিরুকা ইয়াছমিন। শহরের রাহাত্তারপুলে উজির আলী শাহ লেইনে ওই ঘটনাটি ঘটে।
রাহাত্তারপুলের বোয়ালী-কালান্দর শাহ ভবনের দ্বিতীয়তলায় শেখ মো. লেদু পরিবার নিয়ে বাস করেন। তার ছেলে ইরফান এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইয়াবা আসক্ত। মা-বাবার কাছে ইয়াবা সেবনের টাকা চেয়ে না পেলে প্রতিদিন বাসায় গালিগালাজ-ভাঙচুর, মা-বাবা ও ভাইকে মারধর করেন। ঘটনার সময় রাত তিনটার দিকে সে বাসার জানালার কাচ ভাঙচুর শুরু করলে তার ভাই রবিন গিয়ে বাধা দেয়। এ সময় সে রবিনকে মারতে থাকে। তার বাবা রবিনকে রক্ষা করতে গেলে তার গলায় ধারালো ক্ষুর ধরে টান দিতে উদ্যত হয়। রবিন ও তার মা মিলে তাকে রক্ষা করেন। এরপর সে আবারও তার বাবাকে ঝাপটে ধরে ক্ষুর দিয়ে ক্ষুর কেটে দিতে উদ্যত হলে রবিন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এ সময় ইরফানের কাছ থেকে ধারালো দুটি ক্ষুর উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে। পরে তার মা ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কোতোয়ালীর কাজীর দেউড়ি এলাকার রঞ্জন বড়-য়ার একমাত্র ছেলে রবিন বড়-য়া (২৫)। বেকার রবিন ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। নেশার টাকার জন্য প্রতিদিনই মা-বাবাকে পীড়া দিত।
গত ১৪ এপ্রিল ভোরে বাবার কাছে টাকার জন্য বায়না ধরেছিল। টাকা না পেয়ে বাবা রঞ্জন বড়-য়াকে ছুরিকাঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। পরে থানা পুলিশ ব্যাটারি গলি এলাকা থেকে বাবার খুনের দায়ে ছেলে রবিনকে গ্রেপ্তার করে। গত ২মে নগরীর কোরবানীগঞ্জে দিনেদুপুরে ফ্ল্যাট বাসায় প্রবেশ করে ব্যবসায়ীর স্ত্রী রোকসানা বেগমকে (৪৩) খুন ও তার ছেলেকে ছুরিকাঘাতের ঘটনায় জড়িত ছিল মো. সোহেল (৩৫) নামে তাদের দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়। টাকার জন্য সে তার মামীকে খুন করার পাশাপাশি খুনের আলামত নষ্ট করার জন্য বাসায় আগুনও ধরিয়ে দেয়। ওই মহিলাকে মোট ৭৭ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তার ছেলে ঘরে ঢুকতেই তাকে দুইটা আঘাত করেন। গত ১৭ এপ্রিল চান্দগাঁও থানার খরমপাড়া এলাকায় ছোট ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে খুন হয় বড় ভাই মোহাম্মদ সাজু (৩০)। পরে হালিশহর এলাকা থেকে ছোট ভাই মোহাম্মদ মুন্নাকে (২৬) পুলিশ গ্রেপ্তার করেন। দুই ভাই-ই ইয়াবা আসক্ত। পরিবারে তাই নানা অশান্তি লেগেই থাকত।
গত ১৮ এপ্রিল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শফি উদ্দিনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘাতক মুন্না জানায়, তার ১০ পিস ইয়াবা সাজুর কাছে ছিল। গত ১৬ এপ্রিল সাজুর কাছে ইয়াবাগুলো ফেরত চায় মুন্না। কিন্তু সাজু ইয়াবাগুলো সেবন করে ফেলে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরদিন সাজুর কাছে পুনরায় ইয়াবাগুলো ফেরত চায় মুন্না। তখন সাজু মুন্নাকে মারতে আসে। এ সময় মুন্না তার কাছে থাকা টিপ ছুরি দিয়ে সাজুকে আঘাত করেন। গত ১৭ এপ্রিল বোয়ালখালীতে নেশার টাকার জন্য বৃদ্ধা মাকে মারধর করেন মোরশেদ আলম (২২)। অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করে মোর্শেদকে ৪ মাস কারাদ- দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) একরামুল ছিদ্দিক।
ওদিকে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ৫ বছরে নেশাগ্রস্ত সন্তানের হাতে খুন হয়েছেন কমপক্ষে ৩শ’৮৭ জন মা-বাবা। মাদকসেবী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ২শ’৫৬ জন নারী। মাদকাসক্ত প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে খুন হয়েছেন ৬শ’৭০ জন তরুণ-তরুণী। আবার মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় একই সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৮শ’৮৭টি। চট্টগ্রামের সমাজপতিরা বলছেন, ইয়াবার সহজলভ্যতা বেড়ে যাওয়ায় এমন নির্মম ঘটনা ঘটছে। সন্তানের দিকে মা-বাবা ভালভাবে খেয়াল রাখা দরকার। তারা কোথায় যায় এবং কাদের সাথে মিশে তা লক্ষ্য রেখে সঠিক যত্ম নেওয়া প্রয়োজন। ধর্মীয় অনুভুতিও কাজে লাগানো উচিত। তাহলে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা অনেকটা ঠেকানো সম্ভব।