বাংলাদেশি উপন্যাসের অভিজ্ঞতায় আশি ও নব্বই দশকের মধ্যে অবহেলিত লেখিকা পাপড়ি রহমান। তার অবদান অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে। অস্বীকৃত এ অর্থে যে তিনি পুরস্কৃত নন অথবা তাকে নিয়ে আলোচনা কমই হয়। অথচ তার উপন্যাসের ব্যাপ্তি ও গভীরতাকে তুলনা করলে গত প্রায় তিন দশকে যে কয়টি উপন্যাসকে ভালো বলতে হবে তার মধ্যে পাপড়ি রহমানের গুলোও থাকবে।
তার উপন্যাস তালিকায় থাকার পয়লা কারণ এর ব্যাপ্তি। অন্যান্যের মতো মহান অথবা মহৎ কোনো ঘটনা নিয়ে নয়, বাংলার দেশে ইসলাম আসা নিয়ে নয় অথবা কান্না, আবেগ এসবকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তোলা নয়Ñপাপড়ি রহমান তার উপন্যাসকে ভালো করে তুলতে পারেন তার চরিত্রদের দিয়েই।
পাপড়ি রহমানের চরিত্ররা পাঠকের সামনে হাজির করে জীবনবোধ, দার্শনিকতা, মানবিক অ্যাখ্যান।
আর উপন্যাস যে মূলত চরিত্র ও কাহিনিনির্ভর তা নিয়ে তর্কের কিছু নেই এখন আর। যত চরিত্র, তত কাহিনিÑআর ব্যাপ্তিটাও এখানে। উদাহরণ লিও তলস্তয়। তবে পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের ধরন পাল্টালেও চরিত্রের গুরুত্বে ভাঁটা পড়ে নি। উপন্যাস মূলত তার চরিত্র। বাংলাদেশে উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে এই দুবর্লতা এখনো রয়ে গেছে বলতে হয়। যেখানে পাপড়ি রহমান ব্যতিক্রম।
একটা চরিত্রের পেছন থাকবে, সামনে থাকবে, তার জীবনে নদী-পানি-ফল-পাখি থাকবে। আর থাকবে আর এক আধ্যাত্মিকতা, বৈরাগ্যÑপাপড়ি রহমানের উপন্যাসের ব্যাপ্তিটা এখানে।
এর আগে তার ছোটগল্পের সমালোচনায় বলেছিলাম, উত্তর-উপনিবেশী সাহিত্যের ধারা তিনি বহন করেন। যারা স্থানীয় চরিত্রদের নিয়ে ফিকশন গড়ে তোলেন। সেই ফিকশনের স্থানটাও নিজস্ব। পাপড়ি রহমানের ক্ষেত্রে তা আরো ‘পারফেক্ট’।
কারণ তিনি স্থানের সঙ্গে চরিত্রদের জড়িয়ে ফেলেন। মানচিত্রের ভেতর তাদের গড়ে তোলেন। তারা আগন্তুক না।
এই লেখকের ‘বয়ন’, ‘পালাটিয়া’র পর ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ পড়ে এ কথা আরো বিশেষভাবে মনে হলো। একটা উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্রকে জড়ো করা, তাদের শক্ত হাতে বেঁধে রাখাÑএই ক্ষমতা বাংলাদেশের উপন্যাসে কমই দেখা গেছে গত তিন দশকে।
নদীধারা আবাসিক এলাকা উপন্যাসটি বুড়িগঙ্গা তীরের আলো ঝলমল অথচ হয়রান হয়ে ওঠা রাজধানীর বিপরীত পাশের একটি জায়গা নিয়ে। কালো বুড়িগঙ্গার পানি পার হয়ে সেখানে যেতে হয়। পাপড়ি রহমানের উপন্যাসে বুড়িগঙ্গা নিজেই একটা চরিত্র। এর দুই পাশের মানুষ, কোলাহল, পারাপার, নদীর ওপর আকাশ, তাতে ভাসমান মানুষদের স্থানান্তরের এক দীর্ঘ, কর্কশ অথচ বাস্তব এক বিবরণের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হবে পাঠককে।
লেখকের বিবরণে, ‘এই বুড়িগঙ্গার বুকের ওপর এলিয়ে রয়েছে ঢাকা শহর। আর পিঠের ওপর কেরানিগঞ্জ। তিলোত্তমা সুন্দরীকে বুকে রেখে এ নদী যত না সন্তুষ্ট, হতশ্রী কেরানিগঞ্জকে পিঠে ঠাঁই দিয়ে ততটাই বিড়ম্বিত। কাছিমের মতো পিঠে ঝুলে থাকা কেরানিগঞ্জ সত্যিকার অর্থে কুরূপা। তার না-আছে কোনো আভিজাত্য, না-আছে আলগা ঠমকের ঠাটবাট। শুধু কাঁচা টাকা’।
যদিও কুরূপেই রূপের সন্ধানে নামেন পাপড়ি রহমান। বুড়িগঙ্গার কালো পানির তল থেকে কুড়িয়ে আনেন বেদনা-মুক্তা। নীরবে সহে সহে পাপড়ি রহমানের চরিত্ররা পাঠকের সামনে হাজির করে জীবনবোধ, দার্শনিকতা, মানবিক অ্যাখ্যান।
বুড়িগঙ্গা নিয়ে এত বিস্তৃত, করুণ ও ‘মিথিক্যাল’ বিবরণ বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যাবে না আর। পড়তে পড়তে মনে হবে বুড়িগঙ্গার নোংরা পানি আর দুপাশের শব্দ সব কানে আসছে। অসংখ্য ঘাট, এরপর পার হতে হয় যে ব্রিজ সেসবের বিবরণ, মনে করিয়ে দেয় পাপড়ি রহমান নিজেই সেসব তার লেখকসত্তা দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন, তার চোখে ধরা পড়েছে মর্মবাণী, তিনি ইতিহাস আর বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন বুড়িগঙ্গা আর তার দুই পাড়ের কর্মযজ্ঞ আর তার মানুষদের।
উপন্যাসে ঢুকতে কিছু দেরি হলেও এ বিবরণটুকু বাংলা সাহিত্যের এক অভাব পূরণ করেছে। সেটি হলো বুড়িগঙ্গাকে বিপুল ও কাব্যিকভাবে তাকে হাজির করা হয়েছে নদীধারা আবাসিক এলাকায়। সে সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাংলা সাহিত্যের তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কথা। তারা যেমন একটি জনপদকে বিশদ তুলে ধরতেন সাহিত্যে। সেটার উপস্থিতি ইদানীং কমে এসেছে। উপন্যাসের মূল ভাব, বিশদ হয়ে ওঠা তা হারিয়ে যেতে বসেছে বলতে হয়। পাপড়ি রহমান তা থেকেও আমাদের উদ্ধার করলেন। তার সময়ের লেখকদের মধ্যে ডেসক্রিপশন বা বিবরণের অভাব দেখা যায়।
উপন্যাসজুড়েই পাপড়ি রহমানের লেখায় ভর করেন আরেকজন বড় লেখক, তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বিশেষ করে চরিত্র গড়ে তোলায়। এক ধরনের বিভ্রম বা ইল্যুশন থেকে মুক্তি পেতে পারে না আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চরিত্ররা। পাপড়ি রহমানের উপন্যাসেও সেই ধারা দেখা যায়। যা আমাদের অপরিণত মধ্য বা নিম্ন-মধ্যবিত্তের স্বভাব হয়ে উঠেছে।
ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার মতো ব্যর্থ প্রকল্পের মধ্যে নিজেক সঁপে দেন নি পাপড়ি রহমান।
তাহলে বিশদ করা বা উপন্যাসের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে তোলায় পাপড়ি রহমান আমাদের সময়ে এক কষ্টসাধ্য অথচ সাহিত্যিক অবদান রেখে গেলেন বলতে হচ্ছে।
অবদানটা সাহিত্যিক বললাম এ কারণে, আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যে মেটাফরকে এত মহিমাময় করে ব্যবহারের নজির এ সময় নেই। নদীধারা আবাসিক এলাকা উপন্যাসে পাখি, সজনে গাছ, নদী, মেঘÑএতসব প্রকৃতি সামনে হাজির হয় যা চরিত্রের আরেক রূপ হয়ে ওঠে।
যেমন সজনে গাছ নিয় লেখাÑ‘চইত মাস আইতে না আইতে, মরাগাঙে যেন জোয়ার আহে। বছর জুইড়া থাকে কিনা ন্যাডাটুডা; যেই দক্ষিণা হাওয়া আইল, সেই কিনা পাতায় পাতায় ভইরা ফেলায় গতরখানা। হের পরে ফুলে ফুলে হাসতে থাহে গাছডা। যেই ফল ধরল, সেই ফির ল্যাংটা। পাতা নাই, ফুল নাই। ফল আইল কি গাছ গেল ল্যাংটা হইয়া। য্যান কত জন্মের বুইড়া হেয়! এইডা কেমুন ঢকের কতা!’
সজনে গাছের এ অবোধ্য দার্শনিকতার সঙ্গে যেন মিল আছে নারী-শরীরের। তারও ফুল আসে, ফল আসে, শীর্ণ হয় শরীর।
অথবা মেঘের বিবরণ, বৃষ্টি আর জোয়ার-ভাটার আসা যাওয়া, নিমফুল, সন্ধ্যা নামাÑপাপড়ি রহমানের উপন্যাস নারীময়।
এত নারী চরিত্র, এত তাদের স্বস্তি, অস্বস্তি, কত তারা বঞ্চিত, কতকিছু তারা গোপন করে, কী ভীষণ যন্ত্রণা বুকে সয়। তবু তারা অবিচল, তাদের সঙ্গে বোধহয় ঈশ্বরের যোগাযোগ। তারা তবু লড়িয়ে, প্রেমময়।
এই উপন্যাসেই যেমন অজ¯্র নারী চরিত্র ইছমত আরা, রেফুল, শনতারা, নয়তুন্নেছা, তসলিমা, ছেলে সন্তানের আশায় যৌবন পার করে দেয়া সুফিয়া খানম নারী হয়েও নারীর সঙ্গে প্রতারক জুলেখা, দুরদানা। অল্প সময়ের জন্য উপন্যাসে আসা আরো কিছু চরিত্র। তারা সবাই হতভাগী, তাদের সবার ভাগ্য এসে মিলেছে কালো, নোংরা বুড়িগঙ্গায়। তারা ভেসে ভেসে এসেছে, কোন অদৃষ্টে, কোন টানে, কিসে তাদের শেষ আশ্রয় সেসব না জেনে।
উপন্যাসজুড়ে আলাদা অনেক কাহিনি, ঘটনা। কিন্তু তাদের অন্তঃকরণে মিল, নারী হিশেবে মিল রয়েছে। তারা আসলে একই কাহিনির নানা ডালপালা। একটা কাহিনি শুরু, বিস্তার আর শেষÑএই সরল পথের উপন্যাস না। বরং আদর্শ উপন্যাসের মতো অনেক চরিত্র আর তাদের আধ্যাত্মিক মানবিক যোগাযোগ, যে যোগাযোগে স্থানের একটা সম্পর্ক আছেÑসেভাবে গড়ে উঠেছে নদীধারা আবাসিক এলাকা।
ইছমত আরা যেমন হাবুল সরকারের বেইমানির শিকার হয়ে আশ্রয় নেয় জয়নালের কাছে। সেও স্বার্থপর। ইছমত আরার ছেলেও পুরুষ। তারও মেয়েদের বঞ্চিত করা আর মর্যাদা না দেওয়ার ধর্ম। অথবা রেফুল, পাপড়ি রহমান লিখতে লিখতে এক জায়গায় যেমন বলে ফেলেছেন, ‘আমাদের রেফুল’। সেই রেফুল বাবার ঘরের পর স্বামীর ঘরেও পরাধীন। তার নিজের বলে কিছু নাই।
এসব নারী চরিত্র পাপড়ি রহমানের আরেক অবদান বাংলা সাহিত্যে। বাংলাভাষী মেয়েদের এত যতœ করে আর কেউ তুলে আনে নাই। প্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে সেলিনা হোসেন বা শাহীন আখতার সহ অন্যরা নারীবাদী হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলা সাহিত্যে মেয়েদের এত গভীরভাবে, যতœ করে কেউ তুলে আনেন নি বলতে হয়।
তাদের উপন্যাসে নারী থাকলেও পুরুষ দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত থাকে তারা। ইতিহাসে সেসব নারীদের আচরণও সুনির্দিষ্ট, তদুপরি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার মতো ব্যর্থ প্রকল্পের মধ্যে নিজেক সঁপে দেন নি পাপড়ি রহমান।
নদীধারা আবাসিক এলাকার এসব মেয়েরা তালিম নেয়। তালিম অর্থ তারা ধর্ম পালন করে, পুঁথি পড়ে, গজল গায়। নিজেরাই আবার লেখে গজল। পাপড়ি রহমান বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে নিজে এসব দেখে এসে লিখেছেন। দিনের পর দিন তিনি গিয়েছেন সেখানে, থেকেছেন তাদের সঙ্গে। তাদের মনের ভেতর কী করে ঢুকতে পারলেন তা বুঝা দুষ্কর। কিন্তু তিনি পেরেছেন।
তালিম নেয়া যে একটা পেশা, সেটা করে যে একদল নারী জীবিকা নির্বাহ করছেন তা কেইবা জানত। পাপড়ি রহমান সমাজে ধামাচাপা পড়ে থাকা একটি ইতিহাসকেই তুলে এনেছেন এখানে।
‘বাঙালি মুসলমান’ এই রাজনৈতিক পরিচয় তার অবলম্বন।
একটি পরিণত উপন্যাসের সব গুণ নদীধারা আবাসিক এলাকার রয়েছে। স্থান, চরিত্র, বিবরণ, চরিত্রদের একসঙ্গে যুক্ত করতে পারাÑএসব গুণ রয়েছে। রয়েছে কাব্যিকতাও। গদ্যে কাব্য প্রয়োগ অযথা হলে তা বিস্বাদ হয়ে ওঠে। কাহিনির সঙ্গে, চরিত্রের সঙ্গে তা মানানসই না হলে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।
কিন্তু দারণভাবে পাপড়ি রহমান এখানেও নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি চরিত্রদের মনোজগতের মতো করে কাব্য হাজির করেছেন।
তার বই শ্রেণি-ব্যবধানকেও তুলে আনে। ‘বাঙালি মুসলমান’ এই রাজনৈতিক পরিচয় তার অবলম্বন। প্রথাগত প্রগতিশীলতা থেকে দূরে গিয়ে একের পর এক উপন্যাস তিনি লিখেই চলেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন। বর্তমানে গোপন হয়ে থাকা এই সম্পদ কালে কালে নিশ্চয়ই দ্যুতি ছড়াবে বাংলার সাহিত্যসমাজে।
আর শেষ করতে হয় তার ভাষা নিয়ে। কলকাতার ভাষামুক্তি বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য বিশেষ ঘটনা। পাপড়ি রহমান সেই বিশেষ ঘটনাটিও ঘটিয়েছেন। তিনি মুখের ভাষাকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
যারা বুদ্ধিমান, সুবিবেচকÑতারা অবশ্যই আগে আগে পড়ে নেবেন উপন্যাসটি।
(বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। দাম ৪০০ টাকা)