কাল সেই ভয়াল ২৫ মে, আইলার ১০ম বর্ষপূর্তি। ২০০৯ সালের এই দিনে উপকুলিয় জেলা খুলনার দাকোপ উপজেলা প্রবল জ্বলোচ্ছাসের তোড়ে প্লাবিত হয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আইলা নামের ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দূর্যোগের পর ১০টি বছর অতিক্রান্ত হলেও আজো নির্মিত হয়নি নিরাপদ বেড়ীবাঁধ। শত শত নিরাশ্রয় মানুষ এখন বাঁধের উপর মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলমান বাঁধ নির্মানে মাটির পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে বালি। ফলে নির্মিত বাঁধের মাধ্যমে জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত উপকুলবাসী।
২০০৯ সালের ২৫ মে দেশের দক্ষিন পশ্চিম উপকুলিয় অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ আইলা। মুহুর্তের মধ্যে পানির তোড়ে ভেসে যায় খুলনার দাকোপ উপজেলার ওয়াপদা বেড়ীবাঁধ। দিনের আলোতে জ্বলোচ্ছাস আঘাত হানায় প্রানহানীর সংখ্যা কমানো গেলেও দাকোপে ২৩ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। দাকোপের ২টি ইউনিয়নের ৫০ হাজার মানুষ আইলার তান্ডবে সব কিছু হারিয়ে বেড়ীবাঁধের উপর আশ্রয় নেয়। ওই সময়ের উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতে দাকোপে ২৯১৩২ পরিবারের ১০৩৭০০ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ছাড়া ৩২৮০ একর আবাদি জমি, ৩৩৪১৬টি বসতবাড়ী, ২৩৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫৬৩ কিলোমিটার রাস্তা এবং ১১৮ কিলোমিটার ওয়াপদা বেড়ীবাঁধ সম্পূর্নরুপে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ছাড়া গবাদিপশু ও অন্যান্য সহায় সম্পদ মিলে ক্ষতির পরিমান হাজার কোটি টাকার উর্দ্ধে। দেখতে দেখতে ১০টি বছর অতিক্রান্ত হলেও নানা কারনে আইলা আক্রান্ত মানুষের চোখে মুখে এখন হতাশা। সরেজমিন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আইলা বিধবস্থ দু’টি ইউনিয়ন সুতারখালী ও কামারখোলার কয়েকশ’ মানুষ এখন ঘরে ফিরতে পারেনি। সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগী, বাইনপাড়া ও গুনারী এবং কামারখোলার জালিয়াখালী, ভিটেভাঙ্গা এলাকার শত শত পরিবার আজো ওয়াপদা বেড়ী বাঁধের উপর মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এদের অধিকাংশের মাথা গোজার শেষ আশ্রয় টুকু নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে কালাবগী শিপসা পাড়ের ভাঙনে আইলার মত ভয়াবহ পরিস্থিতির আশংকায় এলাকাবাসী। আইলায় দু’টি ইউনিয়নের অভ্যান্তরীন সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্নরুপে বিধবস্থ হয়। যা গত ১০ বছরে এখন পর্যন্ত পূর্ননির্মান করা সম্ভব হয়নি। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ঘুরে দেখা যায় কালাবগী ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের কয়েক শ’ মানুষ বেড়ী বাঁধের উপর টোং ঘর করে অনেকটা নদীর চরে ঝুলে বসবাস করায় ওই অঞ্চলটির নাম করন হয়েছে কালাবগী ঝুলন পাড়া। যাদের একটি অংশ বাস করে কালাবগী ৯ নং ওয়ার্ডের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের উপর। চারিপাশে কোন বেড়ীবাঁধ নেই। কোন রকমে টোং ঘর করে আছে তারা। নদীতে জোয়ার আসলে সাতরিয়ে এসে ওয়ার্ডের মুল ভুখন্ডের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের নৌকায় চড়ে অথবা বই খাতা হাতে নিয়ে সাতরিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। স্বাভাবিক অপেক্ষা নদীতে পানির চাপ একটু বেড়ে গেলেই তাঁদের জীবন শতভাগ হুমকির মুখে। এ যেন জীবন নিয়ে খেলা করা। এখানকার জনগোষ্টির আয়ের উৎস্য বলতে কৃষি, চিংড়ীপোনা আর বনের সম্পদ আহরন। একদিকে জমিতে বালি এবং পলি পড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমান আবাদী জমি চাষাবাদের অনুপযোগী, অপরদিকে ঋণের বোঝায় জর্জরিত কৃষকরা ইচ্ছে থাকলে ঠিকমত চাষাবাদ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরদিকে সরকারী নিষেধাজ্ঞার কারনে অবাধে চিংড়ী পোনা আহরন বর্তমানে বন্দ আছে। এক কথায় বলা যায় খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা মিটাতে না পেরে বহু মানুষ এলাকা ত্যাগে বাধ্য হয়েছে। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দূর্গত এলাকার মানুষের যন্ত্রনার অপর নাম খাবার পানির সংকট। চলমান এই তীব্র তাপদাহে ২৫/৩০ কিলোমিটার দূর থেকে টপ প্রতি ২০/২৫ টাকা দামে পানি কিনে খেয়ে কোন মতে জীবন বাচাচ্ছে তাঁরা। কালাবগী ৯ নং ওয়ার্ডের বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চলের বাসিন্দা হারুন সানা রেজাউল সানাসহ অনেকেই নানা প্রশ্নের উত্তরে হতাশা প্রকাশ করে বলেন এখানে বেঁচে থাকায় আমাদের এখন দ্বায়। একই এলাকার গৃহবধু আনোয়ারা বেগম হতাশার প্রতিক্রিয়ায় বলে, “আসলে আমরা মানুষ না, হয় সৃষ্টিকর্তা আমাগে তুলে নিয়ে যাক, না হয় আমরা এদেশ ছাড়ে অন্য কোন জাগায় চুলে যাবো, আর সহ্য হয়না”। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দাকোপের ২ টি পোল্ডারে ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ কিলোমিটার বেড়ীবাঁধ নির্মানের কাজ চলমান আছে। আইলার অভিজ্ঞতা নিয়ে ভূমি থেকে ১০ ফুট উচ্চতা এবং বাঁধের টপ লেভেলে ১৪ ফুট প্রসস্থ করে প্রকল্পের ডিজাইন করা হয়। জানা যায় ২৬ জানুয়ারী ২০১৬ শুরু হয়ে ৩ বছর মেয়াদী প্রকল্পের কাজ ২৫ জানুয়ারী ২০১৯ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু দাকোপের পৃথক দুটি পোল্ডারে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কাজ এ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছে। প্রকল্প পরামর্শক সুত্রে জানা যায় পরিস্থিতি বিবেচনায় জুন ২০২০ পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। চায়নার দি ফাষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজটি করছে। কিন্তু সেই বাঁধ নির্মান কাজে বড় ধরনের দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ফলে কাজ শেষ হওয়ার আগেই তার স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। জানা গেছে রাস্তা নির্মান কাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাটির পরিবর্তে বালি ব্যবহার করা হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম মূল্য এবং সহজলভ্য হওয়ায় তারা বালি দিয়ে রাস্তা নির্মান করছে। সরেজমিন খোজ নিয়ে দেখা যায় নির্মানাধীন রাস্তার স্লোভ এবং টপ লেভেল মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রাস্তার ভিতরে পুরোটাই থাকছে বালি দিয়ে ভরা। সে ক্ষেত্রে এটাকে বালির রাস্তা বললে ভুল হবেনা। জানা যায় ভাষাগত সমস্যায় চীনাদের সাথে এলাকাবাসী সচরাচর মত বিনিময় করতে পারেনা। আবার নিয়োগকৃত দোভাষীরা অর্থের লোভে ঠিকাদারের স্বার্থ রক্ষায় থাকে তৎপর। যে কারনে কাজের মান নিয়ে স্থানীয়দের সাথে চীনাদের কয়েকদফা বিবাদ সংঘাত হয়। যে ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত মামলার আসামী হওয়ায় এখন আর কেউ চায়না প্রকল্পের কাজ নিয়ে ভয়ে মুখ খুলতে চায়না। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেই সুযোগটি গ্রহন করে রাস্তা নির্মানের নামে করছে হরিলুট। দাকোপের ভুক্তভোগী জনসাধারন বিশ্বব্যাংকের চলমান কাজ নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও চায়না কোম্পানীর তৈরী করা বালির বাঁধ আমাদের জীবনকে আরো বেশী ঝুকির মুখে ফেলছে। এ বিষয়ে তারা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ ও তদারকি কামনা করেছেন।