গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ প্রকৃতিকে সজল বষর্ণে সিক্ত করে দিয়ে সগৌরবে প্রকৃতিতে এসেছে বর্ষা। তাই কবি বর্ষা ঋতুতে মুগ্ধ হয়ে স্বকন্ঠেই উচ্চরণ করেছেন-“ বর্ষা আমি, গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি মায়ার কাজল চোখে মমতার বর্মপুটভরি” এখন বর্ষাকাল। খালে বিলে টুইটুম্বুর বর্ষার পানিতে। আর বর্ষা ঋতুকে কেন্দ্র করে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী, নাজিরপুর ও সদর উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলার বিল ও চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি কাজসহ নানা কাজ উপলক্ষে নৌকার কদর বেড়েছে।
আর এ অঞ্চলের লোকজনের চাহিদা অনুযায়ী বেশীর ভাগ নৌকাই তৈরী করা হয় জেলার স্বরূপকাঠী উপজেলায়। এ নৌকা বেঁচা-কেনার জন্য স্বরূপকাঠী ও পিরোজপুর সদর উপজেলা পাচঁপারা বাজারেও বসেছে বিখ্যাত নৌকার ভাসমান হাট। পিরোজপুর জেলা ও বরিশাল বিভাগের বিল অঞ্চলের মানুষের প্রয়োজনে শত বছর ধরে স্বরূপকাঠী উপজেলার সন্ধ্যা নদীর শাখা খালে আটঘর এলাকায় জলে-ডাঙ্গায় চলে আসছে এ নয়নাভিরাম নৌকার হাট। সভ্যতার বিকাশে নানা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ও ষ্টিমারের রাজত্ব থাকলেও প্রতি বছর বর্ষা ঋতুতে এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও যাবতীয় ছোটখাট ব্যবসা-বাণিজ্যে কদর বাড়ে নৌকার। তাই উপজেলার এই ভাসমান নৌকার হাটে বিভাগের দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতা, বিক্রেতা ও নৌকার হাট দেখার উৎসুখ জনতার ভীড়ে আটঘরে সরগম হয়ে উঠছে। স্বহৃপকাঠী সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আটঘরের সন্ধানদীর খালে ও রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসে দক্ষিণ বঙ্গের বৃহত্তম এই নৌকার হাট আর সপ্তাহে দুদিন বসে পিরোজপুর সদর পাচঁপারা বাজারে সোম ও বৃহস্পতিবার। পিরোজপুরের কাঠ ব্যাবসায় খ্যাত স্বরূপকাঠী উপজেলার ১০ ইউনিয়নের ১৩ টি গ্রামের প্রায় দেড় সহ¯্রাধিক পরিবার বংশ ক্রমান্বয়ে এ পেশা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছে বলে জানান, উপজেলা ও পাশ্ববর্তী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নৌকার হাটে আসা শতাধিক ক্রেতা, বিক্রেতারা। ঝালকাঠীর পাষন্ডা গ্রাম থেকে আসা নৌকা মিস্ত্রি সঞ্জয় গরামী (৪৫) জানান, ৫ বছর ধরে সে এ নৌকার হাটে আসছে। আজকের হাটে সে নৌকা এনেছে বেচা-বিক্রি খুব ভাল বলে মনে হয়েছে তার কাছে। তিনি আরো জানান, নৌকার আকার ও প্রকারভেদে ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮ হাজার টাকার নৌকা ওঠে এ হাটে। আমড়া, আম, রেইনট্রি, কড়াই ও চাম্বল কাঠ তৈরী হাটে আসা সিংহ ভাগ নৌকা।
হাটে আসা একাধিক নৌকা বিক্রেতা ও স্থানীয়দের কাছে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে অত্র উপজেলার দেশ বরণ্য কুড়িআনার আপেল খ্যাত পেয়ারা, আমড়া, চাই দিয়ে মাছ ধরা এবং গো খাদ্য সংগ্রহে নৌকার কদর বেশি থাকে। স্থানীয় নৌকা ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া জানান, অত্র অঞ্চলের মানুষেরা নৌকায় করে খালের মধ্যে ছোট খাট ব্যবসা বানিজ্যে করে থাকে। সে কারণে পেনিস নৌকার চাহিদা একটু বেশি। নৌকা মিস্ত্রি আলিম বলেন, একটি পেনিস নৌকা তৈরিতে তার এক থেকে দেড় দিন সময় লাগে। কাঠ ও মজুরি মিলিয়ে তার খরচ পড়ে ১০০০-১৭০০ টাকা। যা তিনি ৭০০-৯০০ টাকা লাভে বিক্রি করেন। উপজেলার চামী গ্রাম থেকে আসা নৌকা ব্যবসায়ী মোঃ জহিরুল জানান, ৩০ বছর পর্যন্ত সে এই নৌকার হাটে আসছে। সে জানায়, প্রতি জৈষ্ঠ্য থেকে বাংলা আশ্বিন মাস পর্যন্ত এ হাটে নৌকা কেনা-বেচা ধুম থাকে। তবে আষাঢ় ও শ্রাবণে বেচা-বিক্রিতে মহাব্যস্ত থাকে হাটের নৌকা বিক্রেতারা।
চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত, ফসল তোলা, শাপলা তোলা, চাই পাতা, গরুর খাদ্য সংগ্রহসহ নানা কাজে এখানকার বিক্রিত নৌকা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঝালকাঠীর বিনয়কাঠি থেকে আসা নৌকা ক্রেতা মোঃ সাইদুল বলে উঠলেন, এ বছর হাটে নৌকার দাম বেশি। গত বছর যে নৌকা ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে সে নৌকা এবার ৩৫০০-৪০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বলদিয়া থেকে নৌকার হাটে আসা নৌকা মিস্ত্রি সাদিক জানান, ১৯৯১ সাল থেকে সে নিজ হাতে নৌকা বানিয়ে একসাথে ২৫-৩০ টি নৌকা নিয়ে হাটে আসে। তিনি জানান, একটি ১২ হাতি নৌকা তৈরীতে একজনের সময় লাগে ৩-৪ দিন। যার মজুরি ও কাঠ মিলিয়ে খরচ পড়ে ৩২০০-৩৫০০ শত টাকা। যা ১০০০-১৫০০ টাকা লাভে সে বিক্রি করে থাকে। এ বছর নৌকা তৈরীতে কাঠ, লোহাসহ অন্যান্য উপকরন এবং মজুরি বৃদ্ধিতে নৌকার দাম বেশি বলে তিনি দাবি করেন। নৌকা ব্যবসায়ী ও হাটের স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর এ মৌসুমে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন উপজেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের দূর-দূরান্ত থেকে সহ¯্রাধিক নৌকা ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা বড় বড় ট্রলার ও নসিমন যোগে এসে একসাথে ১৫-২০টি নৌকা কিনে নিয়ে যায়। ভাসমান এই নৌকার প্রতি হাটে এই খালে তিন থেকে চার হাজারেরও বেশি নৌকা বিক্রির উদ্দেশ্যে পসরা সাজিয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। নৌকার বিক্রির সময় সাথে বৈঠা দেয়া হয়না। তাই আলাদা করে নৌকা কেনার পরে বৈঠা কিনতে হয় বৈঠা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। উপজেলার ডুবি এলাকা থেকে আসা বৈঠা ব্যবসায়ী মোঃ মহাসিন বলেন, ১০০ টাকা থেকে শুরু করে আকার ও কাঠ অনুযায়ী ৩০০ টাকায় বিক্রি হয় এক একটি বৈঠা। হাটে আসা একাধিক নৌকা মিস্ত্রি ও ব্যবসায়ীরা জানান, উপজেলার স্বরূপকাঠী এবং মিয়ারহাট ও ইন্দ্রেরহাট থেকে তারা সহজলভ্যে কাঠ কিনে হাটে আসা এ সকল নৌকা তৈরী করে থাকেন। উপজেলার শেকেরহাট, কুড়িয়ানা, আতা, বেঙ্গুলি ও ডুবিরহাট, একতা, পঞ্চবেকিরসহ এখানকার মানুষেরা নৌকা তৈরীতে পারদর্শী। নৌকা বিক্রেতা আনোয়র হোসেন অভিযোগ করেন, ইজারাদের চাহিদা বেশি হওয়ায় বিক্রেতা ও কারিগররা তাদের মুনাফা ঠিকমত পাচ্ছেনা। তবে স্থানীয় ইজারাদাররা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নৌকা বিক্রি করতে আসা মিস্ত্রিদের উপর আমরা কখনো কোন প্রকার জুলুম করি না।