দেশে বর্তমানে স্থানীয় সরকারের ৫টি পর্ষদ বিদ্যমান। সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। তন্মধ্যে ৪টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে (Direct vote) নির্বাচিত হয়ে থাকে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিনিধিদের ভোটে (Indirect vote) অর্থাৎ আইয়ুবী আমলের মৌলিক গণতন্ত্রের (Basic Democracy) আদলে নির্বাচিত। তদোপরি পাকিস্তান আমলে স্থানীয় সরকারের ৫টি স্তর বিদ্যমান ছিল। ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, বিভাগীয় কাউন্সিল ও প্রাদেশিক উপদেষ্টা কাউন্সিল।
সেই সময় সিটি কর্পোরেশন ও উপজেলা পরিষদ ছিল না। তখন থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, বিভাগীয় কাউন্সিল ও প্রাদেশিক উপদেষ্টা কাউন্সিলে সরকার প্রতিনিধি মনোনয়ন দান করতেন। থানা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকার বলে সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন), জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতেন পদাধিকার বলে বিভাগীয় কমিশনার। প্রাদেশিক উপদেষ্টা কাউন্সিল প্রাদেশিক গভর্নরের মনোনীত ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও, প্রাদেশিক গভর্ণর ছিলেন এর সর্বেসর্বা বা কর্ণধার।
ব্রিটিশ আমলের ১৯৬ বছরের শাসনের নামে শোষনের কষাঘাতে তাদের অভিপ্রায় ও ইচ্ছানুসারে সরকারি কর্মকর্তা এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধ্বজাধারী, চামচা, চাটুকার, তোয়াজ তোষনে পারদর্শী, জি স্যার, ইয়েস স্যার নমস্য ও পোষ্য লোকদের মধ্য হতে জেলা কাউন্সিল বা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, সদস্য করা হত এবং তাদের মাধ্যমে জেলা কাউন্সিল পরিচালনা করা হত। যা ছিল একটি আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান। যাকে বলা হয়, যেমনি নাচাও তেমনি নাচে পুতুলের কী দোষ।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষে পাকিস্তান স্বাধীন হলে প্রথম দিকে জেলা কাউন্সিলে একই অবস্থা বিদ্যমান থাকে। পরবর্তী সময় আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বা সদস্য নিয়োগ করে থাকে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ (বর্তমানে বাংলাদেশ) এ অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এবং জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা কাউন্সিলের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম, ৬ দফা ও ১১ দফার দাবীকে সোচ্ছার করে তুলে। যার
ফলে স্বৈরাচার পাকিস্তান সরকারের বাধা ও রোষানলে অগনিত ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা ও রাজনৈতিক কর্মী তাদের বুলেটে আহত ও নিহত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জেলা কাউন্সিল বা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের পরিবর্তে নতুন আঙ্গিকে জেলা পরিষদ গঠিত হয়। তখন ডিসির সভাপতিত্বে জেলা পরিষদ পরিচালিত হয়ে থাকে। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সরকার ও ডিসিদের মাধ্যমেই জেলা পরিষদ পরিচালনা করে থাকে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেঃ এইচ.এম এরশাদ সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সি.এম.এল.এ) হিসেবে ক্ষমতায় আসে। ৮৮ সালের প্রহসনের সাধারণ নির্বাচনের পর তার দলের লোকদেরকে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী ভাবাদর্শে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য মনোনয়ন দিয়ে থাকে। ৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পুণরায় জেলা পরিষদের সভাপতি হিসেবে ডিসিদের সভাপতি করা হয়ে থাকে। এমনিভাবে ডিসিদের মাধ্যমে জেলা পরিষদের কার্যক্রম চলতে থাকে। ২০০০ সালে জেলা পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নতুন আইন পাস হয়। ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ৬১ জেলা পরিষদে ডিসিদের পরিবর্তে ৬১ জেলায় জেলা পরিষদে দলীয় লোক প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও তিন পার্বত্য জেলা বাদ থাকে। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম বারের মতো পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সালের ১১ জানুযারী প্রধানমন্ত্রী তার তেজগাঁওস্থ সচিবালয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের শপথ নেন। মোদ্দা কথা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলে জেলা কাউন্সিল (জেলা পরিষদ) যে অবস্থায় ছিল এ অবস্থা থেকে শুধু পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকে। আজও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ও অনেকেই মনে করে থাকে।
২৯ জুলাই সোমবার বাংলাদেশ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফোরাম প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর মর্যাদাসহ ১১ দফা দাবী বাস্তবায়নের জন্য রাজধানীর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের মিলনায়তনে মত বিনিময় সভা করে থাকে। এ সভার ৬ দিন পর ৫ আগস্ট সোমবার ১৮ দফা দাবী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জেলা পরিষদ মেম্বারস এসোসিয়েশন ঢাকাস্থ ফার্মগেটের বাবুল টাওয়ারে সংগঠনের কার্যালয়ে এক সভা করে থাকে। এ নিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের ১১ দফা এবং জেলা পরিষদ সদস্যদের ১৮ দফা সমেত মোট দফা হচ্ছে ২৯।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সম্মেলনে বলা হয় ১ জন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও ৫ জন নারী সদস্য (সংরক্ষিত আসন) রয়েছে জেলা পরিষদে। কিন্তু কার কি কাজ বা দায়িত্ব রয়েছে এ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা নেই চেয়ারম্যানসহ অন্য সদস্যদের। কোন কাজ তদারকি করতে পারবেন বা করা উচিত তাও তারা জানেন না। এ বিষয়টি সূরাহা না করলে জেলা পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য নাকি বাস্তবে রূপ পাবে না বলেও তারা সভায় মন্তব্য করেছেন বলে সূত্রে জানা যায়। বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ জেলা পরিষদ ফোরামের পক্ষ থেকে এলজিআরডি মন্ত্রীকে বিভিন্ন দাবী সম্বলিত ১১ দফা তুলে ধরা হয়েছে। দাবীগুলোর মধ্যে রয়েছে (১) প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর পদ মর্যাদা দিয়ে কর্ম পরিধি নির্বাচন করা (২) জেলা পরিষদের বিদ্যমান সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জেলা পরিষদ ফোরামের মত বিনিময়ের ব্যবস্থা করে দেয়া (৩) জেলা পরিষদ আইন ২০০০ অনুযায়ী জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনার দায়িত্ব জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের ওপর ন্যস্ত করা (৪) জেলা পরিষদকে উপজেলা ও পৌরসভা উন্নয়ন কার্যক্রমের তদারকির দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দেয়া (৫) জেলা পর্যায়ের সব দফতরকে জেলা পরিষদের আওতায় এনে সুসমন্বয়ের মাধ্যমে দফতরগুলোর কার্যক্রম গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা (৬) এডিপির সাধারণ বরাদ্দের কত শতাংশ সংসদ সদস্যরা পাবেন সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করা (৭) জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের জন্য বাস ভবন নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ করা (৮) জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিকাশের লক্ষ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব ডিসির পরিবর্তে চেয়ারম্যানদের ওপর ন্যস্ত করা (৯) জেলা পরিষদের স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর ট্যাক্স ১ ভাগ থেকে ৫ ভাগে উন্নীত করণ এবং একই সঙ্গে জেলা পরিষদের অনুকূলে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা (১০) জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের অভিপ্রায় অনুযায়ী একান্ত সচিব, সহকারি সচিবের পদ সৃষ্টি, চেয়ারম্যানের নিরাপত্তার জন্য গানম্যানের পদ সৃষ্টি এবং জেলা পরিষদের উন্নয়ন কর্মকান্ড যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ সৃষ্টি করা (১১) এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন ও দেশী বিদেশী প্রকল্প জেলা পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকেই মত প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের ১১ দফার মধ্যে অনেক দফাই সাংঘর্ষিক, যেমন জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনার দায়িত্ব চেয়ারম্যানদের ওপর ন্যস্ত জেলা পরিষদকে উপজেলা ও পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রমের তদারকির দায়িত্ব পালন ক্ষমতা, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব ডিসির পরিবর্তে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত করা, এডিপির সাধারণ বরাদ্দের কত শতাংশ এমপিরা পাবেন এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর মর্যাদা প্রদান। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের কাজ কী হবে, তারা কি ভূমিকা পালন করবেন তা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। আইনে কোনটাই পরিস্কার হয়নি। আইনে তাদের ১২টি ফাংশন আছে। একটি ফাংশন হচ্ছে জেলা পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মসূচী পর্যালোচনা। এটা যদি করতে হয় ডিসির নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটি নামে যে পর্ষদ রয়েছে তাহলে সেটা কি হচ্ছে দেখতে হবে। এটা হলে ডিসিদের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) জেলা প্রশাসক পদ পদবীটি এমনিতেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাংবিধানিকভাবে এমপিদের গুরুত্ব একজন সচিবের ওপরে। অপরদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অনেকে মনে করে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের ১১ দফা এবং জেলা পরিষদ সদস্যদের (মেম্বার) ১৮ দফা অনেকাংশে যেমন সাংঘর্ষিক তেমনি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দাবী অনেকেই আমলে নিতে চায়নি। এ প্রসঙ্গে সচিব পদ মর্যাদার একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, একজন প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর পেছনে সরকারের প্রতি মাসে কত টাকা ব্যয়ভার বহন করতে হয় তা চিন্তা করে দেখা দরকার। তাছাড়া ১১ দফার মধ্যে এমন কিছু দাবী পেশ করা হয়েছে যাতে শুধু ডিসিদের ক্ষমতাই কমবে না, নির্বাচিত এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রদের ক্ষমতাও অনেকাংশে বিতর্কিত না হওয়ার সম্ভাবনাকেও একেবারে ওড়িয়ে দেয়া যায় না। তারপর জেলা পরিষদ সদস্যদেরও রয়েছে ১৮ দফা।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে পরোক্ষভাবে প্রতিনিধিত্ব ভোটে নির্বাচিত হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অর্গান হিসেবে বিবেচিত। জাতীয় স্বার্থে এ পদ পদবীটির যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন করে চলাই মুখ্যম। ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারী চেয়ারম্যানদের শপথ অনুষ্ঠানে তাদেরকে জনগণের সেবা, উন্নয়ন এবং নিজ জেলার সমস্যা খুঁজে বেড় করে তা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেয়ার কথা বলা হয়। উন্নয়ন কল্যাণ ও জাতীয় স্বার্থে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অনেকেই মনে করে গাড়ীতে প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর পতাকা, একান্ত সচিব (Private secretary) সহকারি সচিব ও গানম্যানের প্রত্যাশা ও ১১ দফাই বড় কথা নয়। কথা ও কাজের সমন্বয়, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ, গতিশীল নেতৃত্ব ও এলাকার মানুষের ভালোবাসা, সম্মান ও প্রশংসা অর্জনের মাধ্যমে সামনে চলাই হোক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নবচেতনার দিকদর্শন।
লেখক কলামিষ্ট