আর্থিক লেনদেনের কারণেই মসজিদের ইমাম দিদারুল ইসলামকে গলাকেটে হত্যা করেছে তার ঘনিষ্ট বন্ধু মোঃ ওহিদুর জামান (২৮)। গতকাল বুধবার ভোরে সোনারগাঁ থানা পুলিশ তাকে মাদারীপুরের শিবচর এলাকার একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। হত্যাকান্ডের পর মামলাটি ক্লুলেস থাকার ৬ দিন পর এমামলার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। গ্রেফতারের পর হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি লুঙ্গি ও দুটি কোকের বোতল উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়াও ঘটনার পরদিন পুলিশ একটি রক্তমাখা চাপাতি ও একটি চিরকুট উদ্ধার করে। গ্রেফতারকৃত ওহিদুর রহমান খুলনার নড়াইল কালিয়া কলাবাড়ীয়া পশ্চিমপাড়া গ্রামের আবদুর রাজ্জাক টুকু শেখের ছেলে।
হত্যাকান্ডের পর নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের (এসপি) নির্দেশে ক্লু-লেস (কোনো ক্লু ছাড়াই) এ মামলার তদন্তে নামে সোনারগাঁ থানা পুলিশ। তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আসামিকে শনাক্ত করে। গ্রেফতারকৃত আসামি গতকাল বুধবার পুলিশের কাছে ইমামকে হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এর আগে গতকাল বুধবার দুপুরে তার স্বীকারোক্তিতে ঘটনাস্থল সোনারগাঁ উপজেলার নারায়ণদিয়া এলাকার বায়তুল জালাল জামে মসজিদের পাশের একটি পুকুর থেকে ২টি কোমল পানীর বোতল ও একটি লুঙ্গি উদ্ধার করে। এদিকে ইমাম হত্যাকারীকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এলাকাবাসী জানলে ওই এলাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার উৎসুক জনতা আসামীকে দেখার জন্য ভীড় জমায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, আর্থিক লেনদেন নিয়েই হত্যাকান্ডের শিকার হন ইমাম দিদারুল ইসলাম। তার সাথে বিভিন্ন ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আর্থিক লেনদেন হয় তার ঘনিষ্ট বন্ধু ওহিদুর রহমানের। পরবর্তীতে দিদারুল জানতে পারে যে ব্যবসা তার বন্ধু করতে চায় এসব ব্যবসা অবৈধ হারাম। সে স্বর্ণের বারের চোরাচালানের ব্যবসার সাথে জড়িত। তাই সে ওই ব্যবসা থেকে সরে আসতে চায় এবং বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে দেয়া তার টাকা সে ফেরত চায়। এতেই তাকে হত্যা করতে পরিকল্পনা সাজায় বন্ধু ওহিদুর জামান। পরিকল্পনা মতে, হত্যাকান্ডের আগের দিনও দিদারুলের সাথে দেখা করে তার সাথে চা খেয়ে হত্যার পরিকল্পনা সাজিয়ে যায় বন্ধু ওয়াহিদুর জামান। পরে হত্যাকান্ডের দিন এশার নামাজের পর রাতের খাবার প্রস্তুত করার সময় দিদারুলকে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশ্রিত কোমল পানীয় খাওয়ানো হয়। এতেই দিদারুল অচেতন হয়ে পড়ে। দিদারুল অচেতন হয়ে পড়লে তাকে চাপাতি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে বিষয়টি ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য একটি চিরকুট লিখে ফেলে রেখে দরজায় তালা ঝুলিয়ে ঘাতক বন্ধু পালিয়ে যায়। একসময় ইমাম দিদারুল ও হত্যার আসামি কুমিল্লায় একইসঙ্গে পাশাপাশি মসজিদে ইমামতিও করেছে বলে জানাযায়। কিলিং মিশনে আসামি একাই অংশ নেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জানা গেছে, হত্যাকান্ডের পর আসামি ফরিদপুরের দিকে গাঁ ঢাকা দেয়। হত্যকান্ডের পর থেকে আসামি নিজের পরিচয়ও একের পর এক গোপন করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আসামি নিজের পরিচয় বিভিন্ন নামে জাহির করলেও পুলিশ তার সঠিক পরিচয় খুঁজে বের করেতে সক্ষম হয় এবং তাকে গ্রেফতার করে।
দিদারুলের পারিবারিক সূত্র জানায়, দিদারুল তার এক বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসা করবে বলে বিনিয়োগের জন্য দু’টি গবাদীপশু কিছুদিন আগে বিক্রি করে। এছাড়াও সব মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ টাকার কাছাকাছি সে বিনিয়োগ করবে বলে পরিবারকে জানিয়েছিল।
স্থানীয় লোকজন ও মসজিদ কমিটির সদস্যরা জানান, সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া ইউনিয়নের নারায়ণদিয়া এলাকায় বায়তুল জালাল মসজিদের আগের ইমাম চলে যাওয়ায় ২৬ জুলাই পাশের ছোট কাজিরগাঁও মসজিদের ইমাম দিদারুল ওই মসজিদে নিয়োগ পায়। এই মসজিদে জুমার নামাজ পড়িয়ে তিনি প্রশিক্ষণের কথা বলে ছুটি নেন। গত ২১ আগস্ট বিকেলে তিনি ছুটি থেকে ফিরে আবার নামাজ পড়ান। এরপর ২২ আগস্ট ভোরে মুসল্লিরা ফজরের নামাজ আদায় করতে এসে ইমাম না আসায় তার রুমে গিয়ে ইমামের মরদেহ দেখতে পান। এলাকাবাসী পুলিশে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। পরে ওই রাতে নিহত দিদারুলের বড় ভাই মিজানুর রহমান বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে সোনারগাঁ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সোনারগাঁ থানার (এসআই) আবুল কালাম আজাদ জানান, ক্লু-লেস (কোনো ক্লু ছাড়াই) এ মামলার তদন্তে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এ হত্যার প্রধান আসামীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। পরে তার স্বীকারোক্তিতে ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী একটি পুকুর থেকে ২টি বোতল ও একটি লুঙ্গি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামি শিবচর এলাকার ছোট কেশব জামে মসজিদের ইমামতি করতেন।
সোনারগাঁ থানার ওসি মোঃ মনিরুজ্জামান জানান, ইমাম হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রধান আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে অভিযান পরিচালনা করে আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। বিকেলে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে তাকে আজ বৃহস্পতিবার আদালতে পাঠানো হবে।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ জানান, স্বর্ণের বার কিনে ব্যবসা করার জন্য নিহত ইমাম দিদারুল ইসলাম গ্রেফতারকৃত ওহিদুর জামানের সাথে ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য কয়েক দফায় লক্ষাধিক টাকা দিয়েছিল। এ টাকা ফেরত চাওয়ায় গ্রেফতারকৃত চতুর ওহিদুর পরিকল্পনা করে কোমল পানিয়র সাথে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে চাপাতি দিয়ে গলাকেটে হত্যা করেছে। মামলাটি ক্লুলেস হলেও পুলিশের তৎপরতায় হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।