প্রেমই শক্তি, প্রেমেই ভক্তি, প্রেমেই মুক্তি। জগতে প্রেমেরই খেলা। নবী, রাসুল, পীর, অলি, আউলিয়া থেকে শুরু করে সকল ধর্মের সকল অবতারগণই প্রেমের মাধ্যমেই জগতে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন। প্রেম এবং ত্যাগ বিহনে ধর্মের আর কোন বিধান নাই। প্রেম থাকলে ত্যাগ আপনি আসে। মূলত প্রেম। সকল ধর্মের সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান মূলত প্রেম এবং ত্যাগকেই কেন্দ্র করে। প্রেমের ফুল বাহিরে ফুটে না, ফুটে প্রেমিকের অন্তরে। এ ফুলের সুবাস জীবনে যে একবার অনুভব করতে পেরেছে। তার নিকট সমস্ত রাজ্য সুখ বৃথা হয়ে গেছে। সব কিছু ত্যাগ করে, সে ছুটে গিয়েছে সেই সুবাসের অন্বেষনে। ধর্ম রাজ্য মানেই প্রেম রাজ্য। প্রেমহীনের চার আনা মূল্য নেই এখানে। প্রেমের মাধ্যমেই অর্জন করে নিতে হয় মহান প্রভুর সান্নিধ্য। ইসলাম ধর্মে আছে, “আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে- প্রথমে মানুষকে ভালোবাসতে হবে।”
প্রেমের কোন আইন নেই। প্রত্যেকের প্রেমের মধ্যেই ভিন্নতা থাকে, থাকতে বাধ্য। প্রত্যেকেই তার প্রিয়জনকে খুশী করার জন্য নতুন নতুন অনেক কিছুই করে দেখাতে চায়। বড় কথা হলো প্রিয়জন কী চায় এবং কী করে তাকে খুশি করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়- তা বুঝাই হলো জ্ঞান। তাই অতি সুক্ষè জ্ঞানী না হলে প্রেমিক তথা মহান প্রভুকে পাওয়া সম্ভব নয়। মহাপ্রভু প্রেম দিতে চান এবং প্রেম নিতে চান। তিনি প্রেমের ভিখারী। প্রেমের রাজা। প্রেম দিয়েই তিনি জগৎ সংসার সৃষ্টি করেছেন। বিধাতার প্রেমেই স্বর্গের অবস্থান। যিশু খ্রিস্ট বলেছেন: “প্রেমেই পিতাকে পাওয়া যায়।“
প্রেম বিহনে কারও প্রেম আশা করা যায় না। সে প্রেম জাগতিকই হোক আর আধ্যাত্বিকই হোক। রাজ্য লোভে রাজকন্যার প্রতি লোক দেখানো ভালোবাসার কারণে বহু প্রেমিককেই শেষ অবধি খলনায়ক হয়ে করুণ পরিণতি ভোগ করতে দেখা গেছে। কাজেই স্বর্গ লোভে বিধাতাকে ভালোবাসা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ তিনি সব জানেন, সব বুঝেন, সব দেখেন। একটি কথা বুঝতে হবে, শর্ত সাপেক্ষে প্রেম হয় না। স্বর্গের আশা মনে পোষণ করে প্রভুকে ভালোবাসা মানেই রাজকন্যা নয়, রাজ্যই জরুরী। অতএব, যার রাজ্যে বসবাস তাঁকে অবজ্ঞার খেসারত কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আবার যে সে রাজা নয়! তিলে তিলে কানায় কানায় পরিপূর্ণ প্রেম দিয়ে যিনি নিজেই তার প্রেমিককে সৃষ্টি করেছেন অতি সুন্দর অবয়বে!
জাগতিক প্রেমে একজন আরেক জনকে না পেলে মারামারি হানাহানি হতে দেখা যায়। কিন্তু স্রষ্টার প্রেমিক কখনো কারো সাথে মারামারি হানাহানির প্রয়োজনবোধ করেন না। কারণ স্রষ্টা পৃথিবীর সকলকে এক সাথে প্রেম বিলাতে, সকলের প্রেম গ্রহণ করতে ও সকলের সাথে একই সময়ে প্রেমালিঙ্গনের সক্ষমতা রাখেন। তাই “ভালবেসে গেলাম শুধু ভালবাসা পেলাম না”- এ গান গাওয়ারও যেমন সুযোগ এখানে নেই, তেমনি প্রেম নিয়ে প্রতারণা করার সুযোগও নেই। কারণ প্রত্যেকের প্রেমের গভীরতা তিনি ভাল করেই বুঝতে পারেন। তাই অতি চালাক এবং মহাজ্ঞানী এ প্রেমিককে পেতে হলে নিজেকেও হতে হবে অতি সুক্ষè জ্ঞানী। অজ্ঞানী হয়ে কখনো স্রষ্টাকে পাওয়া সম্ভব নয়।
তাই স্রষ্টার সে নিগুঢ় প্রেম পেতে হলে তার সৃষ্টিকেই ভালবাসতে হবে সবার আগে। জগতের নিয়মেও আমরা এর ব্যতিক্রম কোথাও দেখতে পাই না। একজন মানুষের প্রিয় হইতে চাইলে বা তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইলেও দেখা যায়, আগে ঐ মানুষটির ভাল লাগা-না লাগা, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে জেনে নিতে হয় এবং সেগুলিকে তার সাথে মিলিয়ে নিতে পারলে সহজেই বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যায় । এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই তার সৃষ্টি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী প্রশংসা পেতে চায়। অর্থাৎ একজন কবি তাঁর কবিতার, ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসের, গীতিকার তাঁর গানের, সুরকার তাঁর সুরের, কন্ঠশিল্পী তাঁর কন্ঠের, বিজ্ঞানী তাঁর আবিষ্কারের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসেন। মহান স্রষ্টাও এর ব্যতিক্রম নন। তাই বিধাতাকে পেতে চাইলে তার সৃষ্টিকেই গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। ভালো বাসতে হবে প্রাণেপণে। হত্যা বা অশান্তি সৃষ্টি করা তো অনেক দূরের কথা! কবি বলেন: “জীবে প্রেম করে যেই জন/সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” এটা ধর্মেরও মূল বাণী।
জাগতিক প্রেমে যেমন প্রেমিক প্রেমিকা একে অপরকে পাওয়ার জন্যে নিজের মা-বাবা, আতœীয়-স্বজন এমনকি ভোগ বিলাসের রাজ প্রাসাদ ছাড়তেও দেখা যায়, তেমনি বিধাতার প্রেমেও মানুষকে অনেক কিছুই ছাড় দিতে বা ত্যাগ করতে হয়। তাই আমরা সকল ধর্মের সকল মহামানবকেই দুনিয়ার ভোগ বিলাসের জীবনকে পাত্তা না দিয়ে কঠিন সাধনা এবং ত্যাগের মধ্যে ডুবে থাকতেই দেখতে পাই। এই ত্যাগ বনে-জঙ্গলে গিয়ে গৃহ ত্যাগী হয়েও করা যায়, আবার নিজ গৃহে থেকেও করা যায়। সকলের ক্ষেত্রে ত্যাগের রূপ এক রকম নাও হতে পারে। তবে ত্যাগ এবং প্রেমের বিকল্প কখনো ছিল না এবং কখনো থাকবেও না। তাই বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথাতেও যেন মহাপ্রভুর প্রেমের কথাই ফুটে উঠে: “ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালোবাসবে? পথের কাটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কী করে এখানে তুমি আসবে!”
অনেকেই বলেন প্রেমের কোন বয়স নেই। আমি বলি, বয়স থাক বা না থাক যৌবন থাকতেই হবে। প্রেম বা ত্যাগের সময় হলো যৌবন। যার যৌবন নেই তার প্রেম বা ত্যাগ করার কিছুই থাকে না। তাই স্রষ্টাকে পেতে চাইলে যৌবনকেই বিলিয়ে দিতে হবে স্রষ্টার প্রেমে। কুরানে কোরবানি স¤॥^ন্ধে বলা হয়েছে, এমন বকনা গরু কোরবানি দিতে হবে, যার দ্বারা হাল চাষ, পানি সিঞ্চন এবং বীর্য স্খলন হয় নি এবং যার রং হবে হলুদ। সমগ্র পৃথিবীতে নানা রঙের গরু পাওয়া গেলেও হলুদ রঙের গরুর কোন অস্তিত্ব নেই। তাই ‘হলুদ বকনা’ দ্বারা আল্লাহ যে মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ রঙীন বা হলুদ সময় যৌবনকেই বুঝিয়েছেন তা সহজেই বুঝা যায়।
তাই প্রেমের বিধাতাকে পেতে চাইলে প্রেম দিয়েই পেতে হবে। সে প্রেম শুধু স্রষ্টাতে নয়, সৃষ্টিতেও থাকতে হবে। সকল হিংসা, বিদ্বেষ, কাম, ক্রোধ, লোভ, অহংকার, মাৎসর্য্য ভুলে সৃষ্টাকে পাওয়ার সাধনায় প্রেম ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হলেই মানুষের সাথে মানুষের এবং মানুষের সাথে প্রকৃতির নিরাপদ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিধাতা এবং সৃষ্টির মধ্যে এই অমোঘ প্রেম এবং ত্যাগের মাধ্যমেই পৃথিবীতে বহে শান্তির অমিয় ধারা এবং ঘটে আতœার মুক্তি।