১৯৭১ সাল। চারিদিকে যুদ্ধের ডামাডোল বাচ্ছে। বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশকে স্বাধীন করো শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত চারিদিক। মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে নেমেছে বাঙালীরা। ১৩-১৪ বছরের কিশোর বদরুদ্দিন তখনও ভালোমত বোঝে না স্বাধীনতার মানে ? তবে এটুকু বোঝে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। নইলে মুক্তি নেই। বদরুদ্দিনের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর সদর উপজেলার মাচ্চর ইউনিয়নের দয়ারামপুর গ্রামে। তবে শৈশব থেকে তিনি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট মোল্যাবাড়ি এলাকায় বসবাস করতে। বাবা-মা দুজনেই প্রায়ত হয়েছেন। চারভাই পাচবোনের মধ্যে বদরুদ্দীন চতুর্থ সন্তান। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে সংসার। বর্তমানে তিনি ফরিদপুর জজ আদালতে নাজির হিসেবে কাজ করছেন। স্বাধীনতার যুদ্ধের সেই সময়ের সব কিছুই আজো তার স্মৃতিতে সমুজ্জল। যুদ্ধের সেই বিভিষিকাময় দিনগুলি সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীতে পড়তাম। মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকার বড় ভাইদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে শুনেছি। এর চার মাস আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম দেখা হয় আমার। ১৯৭০ সালের নভেম্বরের ঘুর্নিঝড়ে বিধস্ত হয় উপকূলীয় এলাকা। বরিশাল যাওয়ার পথে ফরিদপুরের ভাঙ্গা রাস্তার মোড়ে পথসভা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে বঙ্গবন্ধুর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়েছি। সে সময় ইমাম উদ্দিন আহম্মেদ, এসএম নুরুন্নবী, অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান খান, এপিপি শাহ অ্যাডভোকেট শাহ মো. আবু জাফরের পিতা বিশিষ্ঠ শিক্ষক মরহুম জয়নুল আবেদীন সারের সাথে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়েছি। সেই স্মৃতিমাখা দিনের কথা মনে পড়ে। সেই দিনেই বঙ্গবন্ধু তার মহনীয় মহান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সেই লম্বা মানুষটি আমার হৃদয়ে জাযগা করে নিয়েছিল। সেই মায়াবী চোখ, মুখের সেই স্মিত হাসি আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান। মার্চের পরপরই বদরুদ্দীনের বড়ভাই নাজিমুদ্দীন আহমেদ ও চাচা আবদুস সামাদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিশোর বদরুদ্দীনও তাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চান। সেইদিন বয়স কম হওয়ায় তিনি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু কোন না কোনভাবে তাকে মুক্তিযুদ্ধাদের সাহায্য সহযোগীতা করতে চান। অবশেষে ভাই ও চাচার পরামর্শে বদরুদ্দীন মুক্তিযোদ্ধাদের “ওয়াচার”(তথ্য আদান প্রদানকারী) হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার প্রধান কাজ ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে খোজখবর নেয়া এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সেই সব তথ্য সরবারহ করা। এসব খবর নিতে ফরিদপুর শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। শহরের ঝিলটুলি, আলীপুর, লক্ষীপুর, কমলাপুর, সার্কিট হাউস এলাকা গোয়ালচামট, আলীমুজ্জামান সেতু, শ্রীঅঙ্গণ সেতুর দ্ইু পাশে রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পৌছে দিতেন। আগস্টের মাঝামাঝি একদিন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নিতে যান শহরের তিতুমীর বাজার সংলগ্ন আলীমুজ্জামন সেতুর কাছে। সেইদিনের সেই ঘটনা সম্পর্কে বদরুদ্দীন বলেন, তখন প্রায় দুপুর। সেতুর পশ্চিম পাশে রাজাকারদের অবস্থান। সেখানে আমি ও আমার অন্যান্য স্ঙ্গীদের নিয়ে তাদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গেলে ১০/১২জন পাকিস্তানি সেনা পেছনে থেকে গাড়িতে এসে আমাদেরকে বুট দিয়ে লাথি মারতে শুরু করে। আমরা পালানোর চেষ্টা করি। সে সময় পাকিস্তানি সেনারা আমাদেরকে মেরে ফেলার জন্য গুলি করে। আমার বা পায়ে গুলি লাগলে আমি আহতাবস্থায় সেতুর দক্ষিণপাশে সড়কের খাদে পড়ে যাই। পাক আর্মিরা আমি মরে গেছি ভেবে চলে যায়। পরে অচেতন ও আহতাবস্থায় আমাকে অপরিচিত একজন লোক উদ্ধার করে নিয়ে আসে। পরদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আমাকে আমার বাড়ি দয়ারামপুর পৌছে দিয়ে আসে। আড়াই মাস পর আমি সুস্থ্য হই। বদরুদ্দীন আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দয়ারামপুর, শিবরামপুর, শোভারামপুর গ্রামে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবারহ করেছি। সে সময় আমার পিতা জজকোর্টের সেরেস্তাদার মো. বাকের মিয়াও মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সহায্য সহযোগীতা করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ, পাখিভাই, বাবুনাথদা, আমার বড় ভাই নাজিমুদ্দীন, রমজান ভাই, শাহাবুদ্দিন ভাইসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। বদরুদ্দীনের বিষয়ে ফরিদপুরের বিশিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা একেএম আবু ইউসুফ বলেন, বদর তখন ১৩/১৪ বছরের কিশোর। আমাদের হয়ে সে তথ্য সংগ্রহের কাজ করতো। ওকে আমরা পাক সেনাদের ক্যাম্প এলাকায় পাঠাতাম খবরাখবর নেয়ার জন্য। সে একাজের সময় ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। গুলি খেয়েও ওপর আল্লাহর রহমতে জানে বেচে যায়। সেদিনে যুদ্ধের স্মৃতির ইতিহাস লিখতে গেলে ওর মত অনেক কিশোরের কথা লিখতে হয়। বিশিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক পিকে সরকার বলেন, এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যাদের আত্মত্যাগ রয়েছে তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি বদরের মত যেই সব কিশোর সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে তাদের ভুলে গেলে চলবেনা। তারাতো মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে সামিল হয়েছিল এদেশের স্বাধীনতার জন্য। পিকে সরকারের প্রকাশিত“ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রক্তে ঋত্বিকেরা গন্থে তিনি বদরুদ্দীন সম্পর্কে লিখেছেন, শহরতলীর মুচিবাড়ি ব্রিজের ওখানে পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে রাস্তাকেটে গাছের গুড়ি ফেলে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াস হচ্ছে। সেদিন তন্ময় হয়ে দেখেছিলাম ছাত্রজনতা স্বাধীনতাকমীদের সাথে আমার পাইভেট পড়-য়া ছাত্র কিশোর বালক বদরুদ্দীন আহম্দে এর উৎসায়ী অবয়ব। তার পিতা একই প্রতিষ্ঠানে সেরেশতাদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বার্ধ্যকের এই সময়ে তাই তিনি হাতরে ফেরেন তার সোনালী অতীতকে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার। মুক্তিযুদ্ধাদের তিনি দিয়েছেন সর্বচ্চ রাস্ট্রীয় মর্যাদা। বদরুদ্দীন এই বয়সে শুধু একটি স্বপ্নকে লালন করে চলেছেন মনের গভীরে। আর সেটা হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ। যার গুরু দায়িত্ব সফলভাবে পালন করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা।