মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে সরকারের নীতিমালা বা নির্দেশনা রয়েছে। সেইসব নিয়ম-নীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না বলে প্রায়শই পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হচ্ছে। 'প্রকল্পের অর্থে বিদেশ সফর', 'সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত বিদেশ সফর', 'শিক্ষা সফরের নামে ২০ কর্মকর্তার থাইল্যান্ডে প্রমোদ ভ্রমণ!' এ জাতীয় সংবাদগুলো সত্যিই সুখকর সংবাদ নয়। সর্বশেষ বিদেশ সফর নিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর ‘নিরাপদ পানির জন্য উগান্ডায় প্রশিক্ষণ’ নিয়ে দেশের অধিকাংশ পত্রিকা সংবাদ ছেপেছে। বিষয়টি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ ভাইরাল হয়েছে। নিরাপদ পানির জন্য উগান্ডায় প্রশিক্ষণ যদি অর্থবহ সফর হতো, জনগণের জন্যে সত্যিই তা কাজে আসতো। খোদ ওয়াসা বোর্ডের কয়েকজন সদস্যই এই উগান্ডা ভ্রমণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তারা এই সফরকে দেখছেন ‘আনন্দ ভ্রমণ’ হিসেবে। বাস্তবতাও কি তাই নয়?
নিরাপদ পানির অভাবী দেশে গিয়ে চট্রগ্রাম ওয়াসার কর্তাবাবুরা যা শিখেছেন আর সে শিক্ষা থেকে জনগনকে যা উপহার দিবেন এ জন্য আগেভাগেই তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত আমাদের। উগান্ডা যদি উন্নত একটি দেশ হতো কিংবা সত্যিই যদি তাদের পানি নিরাপদ রাখার কৌশল কার্যকর হতো, তাদের দেশের জনগণ সুপেয় নিরাপদ পানি পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতো– তাহলে হয়ত এই সফরের একটি যৌক্তিকতা আমরা দাঁড় করাতে পারতাম। বস্তুত, বর্তমান প্রেক্ষিতে এই সফরটিকে ‘প্রমোদ ভ্রমণ’ আর তা অর্থের শ্রাদ্ধ উৎসব ছাড়া আর কিছুই না। ওয়াসার কর্তাবাবুরা নিরাপদ পানির প্রশিক্ষণ নিতে এমন দেশেই গেছেন যেখানে মূল যে জিনিস পানি সেই পানি ব্যবস্থাপনাই উন্নত না। তারা শিখেছেন অফিস ব্যবস্থাপনা, গ্রাহক সেবা দেয়ার ফর্মূলা। এটা অযৌক্তিক এবং হাস্যকর বটে!
উগান্ডা ঘুরে এসে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করে প্রকল্প উপ-পরিচালক জানিয়েছেন তারা অনেক কিছু শিখেছেন। কি কি শিখেছেন, দেখেছেন? আরিফুল ইসলাম নামের এই কর্মকর্তা বলেন, “কারিগরি দিক থেকে পানি ব্যবস্থাপনায় উগান্ডা আমাদের চেয়ে উন্নত না হলেও অফিস ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চট্টগ্রাম ওয়াসায় এসব বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।” চেষ্টা চলতে থাকুক। চট্টগ্রাম ওয়াসা উগান্ড থেকে যা শিখেছে তাতে হয়তো চট্রগ্রামবাসী সুপেয় পানি পাবে অনন্তকাল ধরে!
তবে ভালই হয়েছে। ওনারা কি শিখে এসেছেন জানি না আমরা জনগন কিন্তু কিছু একটা শিখলাম। ওয়াসার কর্তাবাবুরা নিরাপদ পানির জন্য উগান্ডা সফর করে না এলে আমরা কি জানতে পারতাম যে, উগান্ডায় নিরাপদ পানি পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের চেয়ে কম? আর ভ্রমণের জন্য ঢের একটা জায়গা। যারা ভ্রমণপিপাসু তাঁরা বড্ড লাভভান হলেন বটে! আনন্দ ভ্রমনের জন্য এখন উগান্ডা যাওয়া যাবে। এই সফরে নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণ সম্পর্কে যদি ওয়াসার ভ্রমণ পিপাসুদেও বাস্তবজ্ঞান লাভ হতো, তাহলে হয়তবা টাকাটা উসুল হতো। আমরাতো জানি উগান্ডা নিরাপদ পানি প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বাজে অবস্থায় আছে। আর সেখানেও আমাদের পানির উন্নয়ন জানতে যাওয়া চাই।
উগান্ডা যদি উন্নত একটি দেশ হতো কিংবা সত্যিই যদি তাদের পানি নিরাপদ রাখার কৌশল কার্যকর হতো, তাদের দেশের জনগণ সুপেয় নিরাপদ পানি পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতো – তাহলে হয়ত এই সফরের একটি যৌক্তিকতা আমরা দাঁড় করাতে পারতাম। কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষিতে এই সফরটিকে ‘আনন্দ ভ্রমণ’ এবং টাকা শ্রাদ্ধ উৎসব ছাড়া আর কিছু বলা যায় বলে মনে হচ্ছে না।
ইদানিং যে যেভাবে পারছেন বিদেশ সফরের কর্মসূচি বাগিয়ে নিচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব থেকে শুরু করে প্রশাসনের মূল কর্তাব্যক্তি সচিব পর্যন্ত প্রত্যেকেই বিদেশ যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ করে প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানরা সফর প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নিচ্ছেন। এমনকি কারো কারো মধ্যে বিদেশ সফরের প্রবণতা এক ধরনের বাতিক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে ঘুরে আসার আগেই আরেকটি সফর কর্মসূচি তৈরি করে রেখেছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তার বছরে ১২ বারেরও অধিক বিদেশ সফরের রেকর্ড রয়েছে। এসব সফরে তার যাওয়া উচিত কি উচিত না- নীতিমালায় পড়ে কিনা- কিছুই বিবেচনা করছেন না। যেসব সফরে সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিদেশ যাবার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে এবং অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তাদের দিতে বলা হয়েছে সেগুলোতেও অহরহ সিনিয়র কর্মকর্তা অর্থাৎ সচিবরা যাচ্ছেন। কোনো বাছ-বিচার নেই। এমনকি বিদেশ সফর নিয়ে নানান লুকোচুরিও চলছে।
এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, 'মন্ত্রণালয়ের টাকায় সাংসদদের বিদেশ সফরে আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে'। অর্থমন্ত্রী বরাবরই মন্ত্রণালয়ের টাকায় সংসদীয় কমিটির সদস্যদের বিদেশ সফরকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তারপরও এ ধরনের সফর বন্ধ হচ্ছে না। উল্টো কীভাবে বেশি বেশি বিদেশ সফরে যাওয়া যায়, তা নিয়ে নাকি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে গুরুত্বসহকারে আলোচনা হয়। তাই সরকারি অর্থে বিদেশ সফর কিছুতেই সীমিত হয় না। বরং এখনো যেসব সদস্য কমিটির মাধ্যমে বিদেশে যেতে পারেননি, তারা মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছেন।
আমাদের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রে এমপি আমলাদের ঘন ঘন সরকারি অর্থে বিদেশ সফর কতটা যৌক্তিক? উন্নত দেশগুলো কীভাবে চলে তা দেখতে এবং শিখতে বিদেশ সফরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে বিষয়টি অনেক বিবেচনার দাবি রাখে। তলিয়ে দেখলে বেরিয়ে আসবে বিগত মাসগুলোয় দেশের রেমিট্যান্স বেড়েছে খুবই সামান্য, আমদানি-রফতানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, বৈদেশিক লেনদেনে তৈরি হয়েছে ভারসাম্যহীনতা। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে তো কমছেই। দেশে চলছে বিনিয়োগ খরা। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এসইসি এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার কারণে শেয়ার বাজারে ইতোমধ্যেই বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে। ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায়ও থেমে নেই এমপি, মন্ত্রী, আমলাদের বিদেশ সফর। কারণে-অকারণেও হচ্ছে এমন সফর। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বার বার সতর্কতামূলক চিঠি দেয়ার পরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর। সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সফরের কারণে বিদেশ সফরে বরাদ্দের টাকায় টান পড়ছে। এক বছরের টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে কয়েক মাসেই। এজন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে হচ্ছে সরকারকে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় সেমিনার ও অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ সফরেই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেশি। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে যাওয়ার পরও সরকারি কর্মকর্তারা ঐ প্রকল্পের অজুহাতে বিদেশ সফর করছেন। এমনকি মন্ত্রীদের চেয়েও বেশি বিদেশ সফর করেছেন এমপি এবং মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা।
বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থে বিদেশ সফর নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের মতামত বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। এর আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বলা হয়েছে, 'মন্ত্রণালয়ের টাকায় সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফর নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়'। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, 'মন্ত্রণালয়ের টাকায় সংসদ সদস্যদের বিদেশ সফরে আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে'। অর্থমন্ত্রী বরাবরই মন্ত্রণালয়ের টাকায় সংসদীয় কমিটির সদস্যদের বিদেশ সফরকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, প্রকল্পের অর্থে বিদেশ সফরের সুযোগ না থাকলে সেই প্রকল্প একনেক সভায় উপস্থাপিতই হয় না। সেখানে দেশের উন্নয়ন বিবেচনা প্রাধান্য পায় না। এমনকি বিদেশ সফরের সুযোগ না থাকলে প্রধানমন্ত্রীর নিজের আগ্রহের প্রকল্পও মূল্যায়িত হয় না। তিনি আক্ষেপ করেন এই বলে যে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সংক্রান্ত ফাইলের অনুমোদন পেতে যত তদবির চলে, দেশের উন্নয়ন বা জনস্বার্থ বিবেচনায় কোনো ফাইলের জন্য তা করা হয় না। প্রধানমন্ত্রীর এই আক্ষেপে জনমানুষের আক্ষেপেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তারপরও এ ধরনের সফর বন্ধ হচ্ছে না। উল্টো কীভাবে বেশি বেশি বিদেশ সফরে যাওয়া যায়, তা নিয়ে নাকি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে গুরুত্বসহকারে আলোচনা হয়। তাই সরকারি অর্থে বিদেশ সফর কিছুতেই সীমিত হয় না। বরং এখনো যেসব সদস্য কমিটির মাধ্যমে বিদেশে যেতে পারেননি, তারা মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছেন।
আমাদের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রে এমপি-আমলা আর প্রকল্প কর্তাদের ঘন ঘন সরকারি অর্থে বিদেশ সফর কতটা যৌক্তিক? উন্নত দেশগুলো কীভাবে চলে তা দেখতে এবং শিখতে বিদেশ সফরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে সময়টা সফর আর ভ্রমণের অনুকূলে নয়। তলিয়ে দেখলে বেরিয়ে আসবে বিগত মাসগুলোয় দেশের রেমিট্যান্স বেড়েছে খুবই সামান্য, আমদানি-রফতানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, বৈদেশিক লেনদেনে তৈরি হয়েছে ভারসাম্যহীনতা। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে তো কমছেই। দেশে চলছে বিনিয়োগ খরা। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এসইসি এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার কারণে শেয়ারবাজারে ইতোমধ্যেই বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে। ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায়ও থেমে নেই এমপি, মন্ত্রী, আমলাদের বিদেশ সফর। কারণে-অকারণেও হচ্ছে এমন সফর। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বারবার সতর্কতামূলক চিঠি দেয়ার পরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর। সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সফরের কারণে বিদেশ সফরে বরাদ্দের টাকায় টান পড়ছে। এক বছরের টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে কয়েক মাসেই। এজন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে হচ্ছে সরকারকে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় সেমিনার ও অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ সফরেই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেশি। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে যাওয়ার পরও সরকারি কর্মকর্তারা ঐ প্রকল্পের অজুহাতে বিদেশ সফর করছেন। এমনকি মন্ত্রীদের চেয়েও বেশি বিদেশ সফর করেছেন এমপি এবং মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
দরিদ্র দেশের অতি সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষের অর্থে লালিত রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জনস্বার্থ বা রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করবেন এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ব্যক্তিস্বার্থ বা নিজ স্বার্থের কাছে অন্য সব স্বার্থ মস্নান হয়ে যায়। অতিসম্প্রতি বঙ্গভবনের নিরাপদ পানির জন্য উগান্ডামতো দেশে যাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এ জাতিয় অপচয় রোধ করা জরুরি। জনগণের অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকার সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।