একটা সময় শিক্ষক মানেই ছিলেন গম্ভীর এবং রাগী স্বভাবের একজন ব্যক্তি। বেত হাতে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢুকতেন, বেত দেখেই পুরো পরিবেশ শান্ত হয়ে যেত। শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের প্রহার অঘোষিতভাবে বৈধই ছিল। এতে অভিভাবকদেরও সমর্থন ছিল। কারণ সেসময় শিক্ষা সহজলভ্য ছিল না এবং পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহও খুব একটা দেখা যেত না। এজন্য অভিভাবকরা সন্তানদের শাসনের ভার শিক্ষকদের হাতে তুলে দিতেন। তাছাড়া সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে শিক্ষকরা যা করতেন তাঁরা তা মেনে নিতেন।
এখন সময় বদলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন। শিক্ষাদানের মাধ্যম এবং ধরণ বদলে গেছে। উন্নত বিশে^ ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করা অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে। আধুনিক যুগে অমনযোগী ও অবাধ্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এসেছে। এখন শিশুরা ভয়ে নয়, শিখবে আনন্দের মধ্য দিয়ে -এমন একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশেও এরকম পদ্ধতি চালু হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা সম্বলিত আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় শাসনের নামে শিক্ষার্থী নিপীড়ন মেনে নেওয়া যায় না। একারণে সরকার নির্দেশনা দিয়েছে, কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের মারধর করা যাবে না। তারপরও দেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হচ্ছে।
যার সর্বশেষ উদাহরণ, হবিগঞ্জে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু ছাত্রীর চোখ বেতের আঘাতে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ঘটনায় বরাবরের মতই অভিযুক্ত শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে স্থায়ীভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ^াসও দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে শিশুর ওপর নির্যাতন বা নৃশংস, অমানবিক, মর্যাদাহানিকর আচরণ বা নির্যাতন না করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ২০০৮ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশব্যাপী আদেশ প্রদান করে। এ বিজ্ঞপ্তির ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, দেশের প্রচলিত নারী নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এ আইন অনুযায়ী শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থী নির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশ্বের সব দেশেই এ আইন কঠোরভাবে মানা হয়। মূলত শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী এ শব্দগুলোর সঙ্গে নির্যাতন নামক কোন শব্দই জড়িত থাকা উচিত নয়। সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করার পরও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায় না এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কথাও শোনা যায় না।
এদিকে, শিশুর অধিকার সুরক্ষায় যথেষ্ট আইন থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। বেশির ভাগ মানুষই জানে না, শিশুদের ওপর নির্যাতন করা হলে শাস্তির বিধান রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তিকে অভিভাবক-শিক্ষক সবাই সাধারণ ঘটনা হিসেবেই ধরে নেন। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন জরুরি। শিশুর ওপর যে কোনো ধরণের নির্যাতন বন্ধে সরকার, সমাজ, শিক্ষক সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে শিশু নির্যাতন বন্ধে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুর ভবিষ্যৎ তৈরির কারখানা, সেখানে নির্যাতন-নিপীড়নে শিশুর অঙ্গহানি ও মানসিক বৈক্যল্য সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি মেনে নেওয়া যায় না।