ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় ঝিঁমিয়ে পড়েছে আনন্দ স্কুলে শিশুদের শিক্ষাদার কার্যক্রম। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন রিচিং-আউট অব-স্কুল চিলড্রেন (রক্স) ফেইজ-২ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ঝড়ে পড়া ৩০ শতভাগ শিশু শিক্ষার্থীদের বিদ্যামুখী করতে ৪২টি আনন্দ স্কুল চালু রয়েছে। এর আগে গত ৫ বছর উপজেলায় ওই প্রকল্পর ফেউজ-১ কার্যক্রম চালানো হয়েছে। গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন বসতবাড়ীর পরিত্যক্ত ঘর ভাড়া নিয়ে চালু করা হয়েছে আনন্দ স্কুল কেন্দ্র। প্রতিটি আনন্দ স্কুলে একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই শিক্ষক ঝড়ে পড়া শিশু শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে শুনিয়ে আনন্দ স্কুলে এনে ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত পাঠদানের দায়িত্ব রয়েছে। এসব আনন্দ স্কুলের ব্যয় বাবদ সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অনিয়, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিদ্যা বিমূখ শিশুরা স্কুলমুখী হচ্ছে না বলে এলাকায় ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার আনন্দ স্কুলের নামে প্রতি বছর বরাদ্দকৃত প্রায় অর্ধকোটি টাকার সিংহভাগ লোপাট হচ্ছে বলেও অভিযোগ।
তবে মঙ্গলবার রক্স প্রকল্পের উপজেলা কো-অর্ডিনেটর বর্ণালী বিশ্বাস জানান, “ এ বছর রক্স প্রকল্প ফেউজ-২ এর দায়িত্ব নিয়ে আমি নতুন জয়েন্ট করেছি। গত পাঁচ বছরের দুর্নীতি ও অনিয়মগুলো আমি এখনো শুধরিয়ে উঠতে পারছি না বিধায় এখনো আনন্দ স্কুলের সঠিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না”।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ওই প্রকল্পের ফেইজ-২ এর আওতায় উপজেলায় মোট ৪২টি আনন্দ স্কুল অফিস নথিতে চালু রয়েছে। প্রতিটি স্কুলে গ্রামগঞ্জের ঝড়ে পড়া ১০/১২ জন করে শিশু শিক্ষার্থী নিবন্ধিত আছে। উপজেলার ৪২টি আনন্দ স্কুলে মোট ছাত্রছাত্রী রয়েছে ৪৪৩ জন। প্রতিজন শিশু শিক্ষার্থীর পোষাকের জন্য বছরে ৫শ’ করে ৪৪৩ জনের ২ লাখ সাড়ে ২১ হাজার টাকা প্রতি মাসে শিক্ষা উপকরনের জন্য শিশু প্রতি ১৮০ টাকা করে বছরে ৯ লাখ ৫৬ হাজার ৮৮০ টাকা, উপবৃত্তি বাবদ ছাত্র প্রতি প্রতিমাসে ১২০ টাকা করে বছরে ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯২০ টাকা, শিক্ষক বেতন বাবদ প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে ৪২ জন শিক্ষকের বছরে ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, ৪২টি আনন্দ স্কুল ঘর ভাড়া বাবদ ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা এবং ঘর মেরামত বাবদ ১ হাজার টাকা করে বছরে ৪২ হাজার সহ সর্বমোট ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ৩০০ টাকা সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এসব আনন্দ স্কুলগুলো হলো- উপজেলার মো. শাহজাহান মিয়ার বাড়ী আনন্দ স্কুল, শেখ ছকেল উদ্দিনের বাড়ী, সুফিয়া বেগমের বাড়ী, তাহমিনা পারভীনের বাড়ী, দুর্জন প্রামানিকের বাড়ী, আইয়ুব খান মাষ্টারের বাড়ী, ইউসুফ মোল্যার বাড়ী, সরোয়ার মেম্বারের বাড়ী শেখ আইয়ুবের বাড়ী, মহিউদ্দিন মাষ্টারের বাড়ী, ইয়াছিন প্রামানিকের বাড়ী, নালু বিশ্বাসের বাড়ী, জুলেখার বাড়ী, আনোয়ার মন্ডলের বাড়ী, হাসান ফকিরের বাড়ী, ছুকেল উদ্দিন মুন্সির বাড়ী, জিতেন মল্লিকের বাড়ী, তপন মন্ডলের বাড়ী, শেখ মুজিবরের বাড়ী, শহীদ পাটাদারের বাড়ী, সেকেন্দার মাষ্টারের বাড়ী, শেখ শহীদের বাড়ী, শেখ কাইমুদ্দিনের বাড়ী, শেখ শহীদের বাড়ী, চানমিয়া মুন্সির বাড়ী আনন্দ স্কুল, আবদুস সালাম মোল্যার বাড়ী, খলিল বেপারীর বাড়ী, শেখ দরবেশের বাড়ী, আফছার মাতুব্বরের বাড়ী, ইসমাইল বিশ্বাসের বাড়ী, আলমাস চৌকদারের বাড়ী, আবদুল হালিমের বাড়ী, মুজিবুরের বাড়ী, শেখ আনোয়ারের বাড়ী, সৈয়দ ডাক্তারের বাড়ী, ফারুক হোসেনের বাড়ী, আবুল হাসেম পালের বাড়ী, আবদুল মালেক মেম্বারের বাড়ী, সৈয়দ আলী মেম্বারের বাড়ী, মান্নান কাজীর বাড়ী, নিলুফা মাষ্টারের বাড়ী, শামসু মাঝির বাড়ী ও হেলিপ্যাড আনন্দ স্কুল।
গত কয়েক দিনে উপজেলার বিভিন্ন আনন্দ স্কুলে সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আনন্দ স্কুলে পাঠদান কার্যক্রম চালু থাকার কথা। কিন্তু উপজেলার চরহরিরামপুর ইউনিয়নের পশ্চিম শালেপুর গ্রামের আবদুল হালিমের বাড়ী আনন্দ স্কুল, মজিবুরের বাড়ী আনন্দ স্কুল, গাজীরটেক ইউনিয়নের জিতেন মল্লিকের বাড়ী আনন্দ স্কুল, চরভদ্রাসন ইউনিয়নের মহিউদ্দিন মাষ্টারের বাড়ী, হেলিপ্যাড আনন্দ স্কুল ও করিমের বাড়ী আনন্দ স্কুলে ঘুরে কোনো ছাত্রছাত্রী বা পাঠদান কার্যক্রম চালু পাওয়া যায় নাই। শুধুমাত্র একটি করে পরিত্যাক্ত ঘরের সাথে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখে প্রকল্পর কাজ সম্পন্ন দেখানো হচ্ছে। নামধারী স্কুলের দরজা জানালা খোলা রয়েছে। ঘরের মধ্যে ময়রা আবর্জনা বোঝাই হয়ে আছে।
বুধবার উপজেলা সদরে হেলিপ্যাড আনন্দ স্কুল কেন্দ্রের শিক্ষিকা সোমা বৈদ্য জানান, “ আমার স্কুলে নিবন্ধিত ছাত্রর সংখ্যা মাত্র ৬ জন। শিক্ষার্থী কম থাকায় প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা বেতনের স্থলে আমাকে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা”। উপজেলার চরহাজীগঞ্জ এলাকার জিতেন মল্লিকের বাড়ী আনন্দ স্কুল শিক্ষিকা দুর্গা রানী মল্লিক জানান, “ শিক্ষা উপকরনের মধ্যে প্রতিমাসে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের একটি খাতা ও একটি কলম দেওয়া হয়। তবে খাতাটিতে লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পূনঃবার দেওয়া হয় না”। আর অফিস নথিতে উপজেলা সদরের মহিউদ্দিন মাষ্টারের বাড়ী আনন্দ স্কুল শিক্ষিকা নওরিন আক্তার মুঠোফোনে জানান, গত তিন মাস ধরে আমি অনত্র চাকুরী করছি, তাই আনন্দ স্কুল নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না”। একই দিন ওই বাড়ী মালিক মহিউদ্দিন মাষ্টার বলেন, “ গত তিন মাস আগে উপজেলা কো-অর্ডিনেটর বর্ণালী বিশ্বাস আমার কাছ থেকে সই নিয়ে ঘর ভাড়া চুক্তি শেষ করেছেন। এরপরও অফিস নথিতে মহিউদ্দিন মাষ্টার বাড়ী আনন্দ স্কুল কিভাবে বহাল থাকে তা আমার বোধগম্য নয়”। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল বাসার মো. বাহাউদ্দিন বলেন, “ অত্র উপজেলায় আমার নতুন পোষ্টিং হয়েছে, আনন্দ স্কুলের বিষয়গুলো আমি শক্ত করে দেখবো”। আর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরীন বলেন, “ প্রতিদিন গ্রাম থেকে ঘুরে ঘুরে শিশুদের ডেকে এনে আনন্দ স্কুলে পাঠদান প্রত্যেক শিক্ষকের গুরু দায়িত্ব। এ দায়িত্ব অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে”।