আমেনা বেগম। স্বামী আমিনউদ্দিন মারা যাওয়ার পর জীবনে নেমেছে অন্ধকার। মাথাগোজার মতো নিজের একটি ঘর নেই। অসহায় এই নারী সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরের জন্য আবেদন করেন। তিনি একটি ঘর বরাদ্দও পান। তবে এজন্য তাকে গুণতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা। এই টাকা দিতে হয়েছে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইনামুল হাসানকে। ওই নারীর বাড়ি গোপালপুর ইউনিয়নের কামারগ্রামে। চেয়ারম্যানকে উৎকোচ দেওয়ার জন্য এই টাকা তিনি জোগাড় করেছেন মানুষের কাছ থেকে সুদে ঋণ নিয়ে।
দুর্নীতির এমন অসংখ্য অভিযোগ আছে গোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাইব্রিড ছাত্রলীগ নেতা খ্যাত ইনামুল হাসান ও তার ভাই সাবেক ছাত্রদল ও বর্তমানে যুবদল নেতা মাহাবুব আলমের বিরুদ্ধে। নিজে কোনো পদ-পদবীতে না থাকলেও কেবল চেয়ারম্যানের ভাই পরিচয়ে মাহাবুবের দাপটে তটস্থ থাকেন ইউনিয়ন পরিষদের অন্যান্য মেম্বারসহ সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দুই ভাইয়ের অনিয়ম ও স্বেচ্ছারিতায় দুর্নীতির আখড়া হয়েছে গোপালপুর ইউনিয়ন কার্যালয়। যেখানে টাকাই ছাড়া কোনো সেবাই মিলে না সাধারণ মানুষের। সাধারণ নাগরিকত্বের সনদের জন্যও টাকা দিতে হয়। অসহায়, দুস্থদের জন্য সরকারের ভিজিডি কার্ড পেতে গেলেও চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়। টাকার বিনিময়ে এসব সরকারি সুবিধা নিচ্ছে অযোগ্যরা। তার ওপর ভিজিডিতে সরকারি বরাদ্দের চাল বা গম থেকেও ভাগ নেন চেয়ারম্যান। বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে ফরিদপুর জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগ।
স্থানীয়রা বলেন, একসময় টিনের ঘর ছিল ইনামুলদের। তাও এতটা নাজুক ছিল যে, ঝং ধরে টিন ঝুরঝুরিয়ে পড়ে ফুটো বেরিয়ে থাকতো। সেখানে এখন ইটের দালান উঠেছে। অথচ ইনামুল, তার ভাই মাহবুবের কোনো পেশা নেই। ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ আত্মসাৎ, দুর্নীতি-অনিয়মে বনে গেছে কাড়িকাড়ি টাকার মালিক।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান ইনামুল হাসান ও তার পরিবারের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে বখাটে ও দাঙ্গাবাজ বলে পরিচিত। চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তারা বিভিন্ন সময় নানা সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। হামলার জেরে একাধিক মামলায় আসামি ছিলেন।
স্থানীয় একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বর্তমানে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টকে গোপালপুর বাজারে ইনামুল ও মাহবুবের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী পিটিয়েছে। বাজারের মানুষ সবাই তা দেখেছে। অথচ কোনো বিচার হয়নি। শামসুদ্দোহা শিমুর অপরাধ ছিল, তিনি বলেছিলেন, রাজাকার গোলাম কুদ্দুসের ছেলে ইনামুল হাসান কেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবে ইউনিয়ন পরিষদে? এই প্রশ্ন তোলায় তাকে মারপিট করা হয়।’
কামারগ্রামের প্রবীণ একজন বাসিন্দা বলেন, ‘ইনামুলের বাবা গোলাম কুদ্দুস মাতব্বরেরও কোনো পেশা ছিল না। সে গোটা আলফাডাঙ্গায় দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল হিসেবে পরিচিত ছিল। ভাড়ায় লাঠিয়াল হিসেবে খেটে জীবনের লম্বা সময় মামলা-মোকদ্দমা করেই পার করেছে। তাদের দেখে মানুষ সব সময় ভয় পেতো। যাকে না তাকেই বিনা কারণে মারপিট করতো। সেই বাড়ির সন্তান ইনামুল, মাহবুবরা চেয়ারম্যান হয়ে দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’
স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘একাত্তরে কুদ্দুস মাতব্বর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করেছে। সে ছিল শান্তি কমিটির লোক। পরে একসময় জাতীয় পার্টির কর্মী। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু যাচাই-বাছাইয়ের বারবার বাদ পড়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে কটূক্তি করেছে।’
ইউপি কার্যালয়ে জুয়া-মাদকের আসর
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দোতলায় একটি ঘর স্থানীয় বখাটে ও সন্ত্রাসীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন চেয়ারম্যান। যেখান থেকে প্রতিমাসে তার ভাই মাহাবুব ভাড়া তোলেন। বখাটেরা ওই ঘরটিতে প্রতি সন্ধ্যায় মাদক ও জুয়ার আসর বসায়। অসামাজিক কাজেও ঘরটি ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সারাদিন সেখানে নানা অকর্মের ষড়যন্ত্র করা হয়। এনিয়ে স্থানীয়রাও অস্বস্তিতে আছেন। হামলা-মামলার ভয়ে তারা মুখ খোলেন না।
টাকা ছাড়া মেলে না সনদ-ভিজিডি কার্ড, বেনামে ভাতার টাকা আত্মসাৎ
ইউনিয়ন পরিষদের একটি সূত্র জানায়, ইনামুল হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ওয়ারিশ, নাগরিকত্ব ও জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য টাকা আদায়ের নিয়ম চালু করেন। যা অনেকের মধ্যেই ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। প্রয়োজন মেটাতে মানুষ বাধ্য হয়ে টাকার বিনিময়ে এসব সেবা নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে পাওয়া নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, টাকার বিনিময়ে গরিব-দুস্থদের জন্য সরকারের ভিজিডি কার্ড চলে যাচ্ছে স্বচ্ছ ও অযোগ্যদের হাতে। প্রতিটি কার্ডের বিনিময়ে ইনামুল ও তার ভাই চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা উৎকোচ নিচ্ছে। তার চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে, বেনামে ভিজিডি কার্ড করে চেয়ারম্যান নিজেই সেই টাকা আত্মসাৎ করছে। এর মধ্যে ভিজিডির তালিকায় তানিয়া সুলতানা নামে একজনকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যার স্বামীর নাম দেওয়া হয়েছে নুরুল ইসলাম, গ্রাম চান্দড়া। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, এই নামে কোনো বাসিন্দা চান্দড়ায় নেই। এ ছাড়া মোছা. ছালেহা, স্বামী লিয়াকত ফকির, গ্রাম চান্দড়া। এই নামে কোনো লোক পাঁচ গ্রামে পাওয়া যায়নি। এটিও যাচ্ছে চেয়ারম্যানের পকেটে। কটুরাকান্দি নামে গ্রামে বসবাস করেন রুবা খানম। তিনি গোপালপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা নন। কিন্তু টাকার বিনিময়ে তাকেও ভিজিডি কার্ড দিয়েছেন চেয়ারম্যান। এ ছাড়া বেনামে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও গর্ভবতী ভাতার হাজার হাজার টাকা আত্মসাৎ করছেন চেয়ারম্যান ও তার ভাই। এ কাজে তাদের সঙ্গে আছেন চেয়ারম্যানের খালাতে ভাই আবুল হাসান।
বরাদ্দের চাল আত্মসাৎ
গুরুতর অভিযোগ আছে ভিজিডি কার্ড গ্রহীতাদের নামে বরাদ্দকৃত চাল বা গম আত্মসাতেরও। সরকার থেকে প্রতিটি কার্ডের অনুকূলে ৩০ কেজি চাল বা গম বরাদ্দ থাকলেও কার্ড গ্রহীতাদের দেওয়া হয় চার কেজি কম ২৬ কোজি। এ ছাড়া কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির রাস্তা নির্মাণেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ইউনিয়নের চান্দড়া গ্রামের উত্তরপাড়া বেড়ীবাধ থেকে সোবহান সর্দারের বাড়ি পর্যন্ত সড়কটি নির্মাণের জন্য ছয় টন গম বরাদ্দ হলেও ওই কাজে ব্যয় হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। একইভাবে কুচিয়াগ্রাম দেলবারের বাড়ি থেকে টেপুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় সমপরিমাণ বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা। বাকি টাকা গেছে চেয়ারম্যানের পকেটে।
প্রবীণ স্কুল শিক্ষক ওবায়েদ হোসেন বলেন, ‘বোর্ড অফিসের দুর্নীতির খবর শুনেছি। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। গরিব-অসহায়দের বঞ্চিত করে তাদের অনুদান আত্মসাৎ যা করছে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার।’
সাবেক ইউপি মেম্বার প্রবীণ, মনসুর মোল্লা বলেন, ‘ইনামুল চেয়ারম্যান ও তার ভাই মাহবুব যা করছে তা প্রকাশের কোনো ভাষা নেই। সরকারি বরাদ্দ লুটেপুটে খাচ্ছে। এটা তো চলতে পারে না।’
আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রতিটি ঘরের জন্য ২০ হাজার টাকা উৎকোচ
অভিযোগ আছে, সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দের জন্য প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করেছেন চেয়ারম্যান। এসব ভুক্তভোগীরা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রতিকার পাননি।
ইউপির রাজস্ব আত্মসাৎ
অবৈধভাবে ইউনিয়ন পরিষদের রাজস্ব আত্মসাতের অভিযোগও আছে চেয়ারম্যান ইনামুলের বিরুদ্ধে। গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে গোপালপুর ও দিগনগর খেয়াঘাট রয়েছে। গত অর্থ বছরে গোপালপুর খেয়াঘাট দেড় লাখ টাকায় এবং দিগনগর খেয়াঘাট এক লাখ টাকায় ডাকে ইজারা দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইজারার এই অর্থ সরকারি কোষাগারে পুরোটা জমা হয়নি। এখান থেকে আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান।
এছাড়া ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গোপালপুর বাজারটির রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য গত অর্থবছরে উপজেলা থেকে এক লাখ আট হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজ হয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকার মতো। বাকি টাকা চেয়ারম্যান তসরুফ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
চেয়ারম্যান ইনামুল, তার ভাই মাহবুব ও খালাতো ভাই আবুল হাসানের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনার স্থানীয়দের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কেউ এসব নিয়ে সরব হলে তার ওপর অত্যাচারের খড়গ নামার আশঙ্কায় কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না।
যোগাযোগ করা হলে আলফাডাঙ্গার গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইনামুল হাসান বলেন, ‘আমার কোনো পেশা নেই। পুরো সময় চেয়ারম্যানের কাজ করেই কূল পাই না। অন্য কাজ করবো কখন? আর এসব নিয়ে আপনাদের এত মাথা ব্যথা কেন?’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মেঝো ভাই মাহবুব বোর্ড অফিসের কাজে সহযোগিতা করে। এতে দোষের কিছু নাই।’
জানতে চাইলে গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান ইকু বলেন, ‘আমরা লজ্জিত। বোর্ড অফিসের অনিয়মের কথা মানুষের মুখে মুখে। দলীয় নেতাকর্মীরা রাতদিন খেটে তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে। অথচ তার এসব কা-ে আমাদের লজ্জা পেতে হয়।’
এ ব্যাপারে আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল বাসার মিয়া বলেন, ‘শুনেছি ইনামুল হাসান ও তার ভাই মাহবুব গোপালপুর বোর্ড অফিসে অনেক অনিয়ম করছে। নাগরিক সনদ, বিভিন্ন কার্ড দিতেও নাকি টাকা নেয়। এগুলো বন্ধ না হলে তো সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
ফরিদপুর জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করি। গোপালপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বিষয়টিও তদন্তনাধীন আছে। তদন্তে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’