নাম শ্রীমতি পঞ্চমী পাল। বয়স প্রায় ৬৭ বছর। খুব অল্প বয়সে তার বিয়ে হয় একই এলাকার পাল বংশের শ্রী অমুল্য চন্দ্র পালের সাথে। সংসার জীবনে তাদের দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। বিয়ের পরে স্বামীর পেশা মাটির তৈরী মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরীর কাজে সাহায্য করে আসছেন। সেই সময় তাদের বাড়ি থেকেই মাটির তৈরী জিনিসপত্র লোকজন কিনে নিয়ে যেতো। কালের পরিবর্তনে বর্তমানে প্লাষ্টিক ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরী আধুনিক জিনিসপত্রের কারণে এবং সরকারী ভাবে কোন সহযোগীতা না পাওয়ায় আজ তাদের বাপ
দাদার মৃৎ শিল্পের এ ব্যবসা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই মাটির তৈরী জিনিসপত্র এখন চলে না।
শনিবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে গেলে এভাবেই কথা গুলো বলছিলেন
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত ঘেষা দিঘলটারী
গ্রামের কুমারটারীর বাসিন্দা শ্রীমতী পঞ্চমী রানী পাল।
শ্রীমতি পঞ্চমী পাল আরো বলেন, তার যখন বিয়ে হয় তখন তাদের সংসারে কোন অভাব ছিল না। বিয়ের ৬ বছরের মধ্যেই তাদের ঘরে দুই ছেলে সন্তান আসে। সংসারে অভাবের কারণে বর্তমানে বড় ছেলে সন্তোষ চন্দ্র পাল রংপুরে লেবারের কাজ করে আর ছোট ছেলে প্রশান্ত চন্দ্র পাল তার বাপ দাদার এই
ব্যবসাকে ধরে রেখেছে। তিনি বলেন, তাদের মাটির তৈরী জিনিসপত্রের এই ব্যবসা আগের মতো আর চলে না। আগে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কুয়া দেখা যেতো। কুমারীটারীর এই কুমারদের তৈরী মাটির পাট দিয়েই এই কুয়া তৈরী হতো। আর কুয়া থেকে মাটির তৈরী কলস দিয়েই পানি নিয়ে আসতেন নারীরা। মাটির হাড়িতেই বাড়িতে ভাত রান্না করা হতো। খাওয়া দাওয়াও করতেন মাটির তৈরী প্লেটে। পানি খেতেন মাটির তৈরী গ্লাসে। কিন্তু এখন আর ওসব কিছুই চোখে পড়ে না। প্লাষ্টিক, চিনামাটি ও সিমেন্টের কারণে পাল বংশের এই প্রাচিন ব্যবসা বিলুপ্তির পথে।
পাশের বাড়ির পঞ্চাশোর্ধ বিধবা উর্মিলা বালা পাল বলেন, তিন মেয়ে ও এক সন্তানের সংসারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি ছিলেন তার স্বামী। ভারে ফেরি
করে তার স্বামী বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাটির তৈরী বাঘ, সিংহ, হরিণ, ঘোড়া, টব, মাটির ব্যাংকসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। সারাদিন বিক্রি করে যে আয় হতো তার একটি অংশ মাটির কেনার জন্য রেখে কোন রকম সংসার চালাতে হতো। এই কষ্টের মধ্যেই তাদের তিন মেয়ের বিয়ে দেন। ছেলে বড়হওয়ায় সে তার বাবাকে সহযোগীতা করতে থাকে। কখনো তার বাবাকে আবার কখনো অন্যের জমিতে কৃষি কাজ সংসারে সহযোগীতা করে আসছে। দুই বছর আগে ছেলেও বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীতে তার স্বামী মারা গেলে তিনিও ভেঙ্গে পড়েন। চিকিৎসার অভাবে কারণে এর মধ্যেই শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধতে থাকে। চোখেও ঠিক মতো দেখতে পাননা। তাই
আগের মতো মাটির তৈরী জিনিসপত্র বানাতে পারেন না। ছেলে ও ছেলের বউ অন্যের কাজ করার পর যতটুক সময় পায় ওই সময়েই মাটির কিছু খেলনা তৈরী করেন। পরে সেগুলো আগনে পুড়িয়ে কাধেঁ করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন তিনি। এভাবেই তার সংসার চলছে। তবে সরকারী কোন সাহায্য বা
সহযোগীতা এখন পর্যন্ত পাননি বলেও জানান তিনি।
লক্ষী বালা পাল বলেন কিছুদিন আগে তার স্বামী নগেন চন্দ্র পাল মাত্র বছর বয়সে মারা যায়। দুই ছেলেকে অতিকষ্টে জীবন যাপন করে আসছে। তাদের মাটির তৈরী জিনিস বাজারে তেমন বিক্রি না হওয়ায় বড় ছেলে রবিন চন্দ্র পাল ভ্যান চালায়।
অন্য সময় যখন মাটি পাওয়া যায় তখন মাটির তৈরী বিভিন্ন খেলনা তৈরী করে বাজারে বাজারে বিক্রি করে। ছোট ছেলে লিটন চন্দ্র পাল অন্যের দোনে কাজ করে সংসার চালায়।
কুমারটারীর ৭৫ বছর বয়সী অমুল্য চন্দ্র পাল বলেন, জন্মের পর থেকেই দেখছি তার বাপ দাদারা এ ব্যবসা করে আসছেন। পাল বংশের এইকুমারটারীতে ২৭টি পরিবার এই ব্যবসার সাথে জড়িত। সেই সময় তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন তিনি। অল্প বয়সেই তিনি তার বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নেন।
তিনি বলেন, চাহিদা থাকায় একসময় মাটির তৈরী তাদের ৫১ প্রকার মাটির তৈরী জিনিসপত্র বাড়ি থেকেই কিনে যেতেন অনেকে। কালের পরিবর্তনে এবং প্লাষ্টিক ও সিমেন্টের তৈরীর জিনিসপত্রের কারণে বর্তমানে তাদের এ ব্যবসা প্রায় বিলুপ্তি পথে। আগের মতো তাদের এ ব্যবসা আর চলে না। তাই সংসার চালাতে এই পাল বংশের অনেকেই অন্যের জমিতে এবং রিক্সা ভ্যান চালাতে হচ্ছে। সেই সাথে এসব মাটির তৈরীর জন্য মাটিও পাওয়া যায় না। তিনি আরো বলেন, আমরা পাল বংশের মানুষ গুলো বরাবরেই সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছি। অথচ ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিগন আমাদের সরকারী সাহায্য এনে দিবেন বলেপ্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর আর তাদের কথা মনে রাখেনা।
দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছালেকুজ্জামান প্রামানিক ছালেক বলেন, কুমার পল্লীর ২৭ পরিবারের সকলের নামের তালিকা করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানকার কয়েকজনের বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।