যারা বিদেশে গিয়ে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে আয় করেন, তারা নিজ সংসারের আর্থিক অবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স পাঠান। অর্থাৎ তাদের প্রবাসে কাজ করার মাধ্যমে দেশ উপকৃত হয়, রেমিট্যান্সের যে অর্থ পাওয়া যায়, যাতে দেশ চলে। কিন্তু এই শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তার চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক হলো, যখন আমাদের মা-বোনেরা দেশের বাইরে কাজ করতে গিয়ে যৌন হেনস্তাসহ নানা ধরণের শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।
গত কয়েক বছরে অনেক নারী শ্রমিক লাশ হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। যেসব নারী শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরে এসেছেন, তাদের সব সৌদি আরব থেকে নয়; জর্ডান, লেবানন, আরব আমিরাত, ওমানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এসেছেন। তবে সৌদি আরব থেকে আসার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তাদের মৃত্যুর নানা কারণ বলা হয়েছে কিন্তু আত্মহত্যার সংখ্যাও কম নয়। তাছাড়া শুধু লাশ হয়েই নয়, কাজের জন্য গিয়ে পুরো সময় পার না করেই নানা ধরনের নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরে এসেছেন অনেক নারী।
প্রায় ছয় বছরের নিষেধাজ্ঞা থাকার পর ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সৌদি আরবের শ্রমবাজার বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। এ বছরেই ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে বাংলাদেশ সরকার গৃহশ্রমিক পাঠানোর জন্য একটি চুক্তি করে। এ চুক্তির একটি ধারায় বলা হয়, তিনজন পুরুষ শ্রমিক নিতে হলে একজন নারী গৃহশ্রমিক দিতে হবে। মূলত এই চুক্তি অনুসারে সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে আমাদের দেশের নারীদের পাঠানো হয়। গরীব ও কম লেখাপড়া জানা নারীদের জন্য কাজের ক্ষেত্র গৃহশ্রমিক ছাড়া সীমিত। তাই তারাও বাধ্য হন এ কাজ করতে। সৌদি নাগরিকরা গৃহশ্রমিক হিসেবে সহজে এবং সস্তায় নিতে পারেন বলে তাদের আগ্রহ আছে বাংলাদেশী নারীদের প্রতি। কিন্তু কাজের বদলে আমাদের নারী শ্রমিকদের সেখানে নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানির শিকার হতে হচ্ছে। সৌদি আরবে যে এ ধরনের গৃহশ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তা নতুন নয়। ২০১০ সালেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার নারী শ্রমিকদের ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়। যে কারণে সৌদি আরবে কেউ গৃহশ্রমিক হয়ে যেতে চান না। তবু বাংলাদেশ থেকে এখনও নারীদের গৃহশ্রমিক হিসেবে পাঠানো হয়।
বিদেশে বিশেষ করে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো নিয়ে সম্প্রতি সংসদে এমপিদের তোপের মুখে পড়েন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী মো. ইমরান আহমেদ। সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে এ নিয়ে তাকে একের পর এক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এ সময় তাকে বিরোধী দলের একাধিক এমপি বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের ওপরে যৌন নির্যাতনের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। স্বাধীন দেশের মানসম্মান রক্ষায় সৌদি আরবে নারী শ্রমিক না পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। এমপিরা দাবি করেন, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুঁড়ি নয় যে, নারীদের সম্ভ্রমহানির জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে। এর পরিবর্তে বেশি করে পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর কথা বলেন তারা। নারী কর্মীদের বিদেশে পাঠানো বন্ধের দাবি জানান তারা। তাদের দাবির সাথে দ্বিমত করার কোনও যুক্তি নেই।
সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়- এটা স্বীকৃত। সেখানে যারা প্রাণ হারাচ্ছেন সেই ক্ষতি পূরণীয় নয়। আবার যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসছেন বা পালিয়ে আসছেন, তারা সামাজিকভাবে নানা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে তাদেরকে তাদের পরিবারও আর গ্রহণ করছে না। এটা খুবই দুঃখজনক ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা। আমরা চাই না, আমাদের দেশের আর একজন নারীও এই বিভীষিকার মুখোমুখি হোন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য নারী নির্যাতনকারী দেশে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হোক। বিকল্প হিসেবে দেশেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেখানে কাজের সুযোগ করে দেয়ার ব্যাবস্থা করার আহ্বান জানাই।