দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর মধ্যে ¯্রােতোবহা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত কীর্তনখোলা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এ নদীটির ওপর নির্ভর করে মৎস্যজীবীরা যেমন জীবিকা নির্বাহ করছেন, তেমনি এই নদী ব্যবহার করেই পণ্য ও যাত্রীবাহীসহ সবধরনের নৌযান দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকা-চাঁদপুরসহ উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করছে।
কীর্তনখোলা অন্য সব নদীর মতো সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নিয়মে গতিপথ পরিবর্তন করছে এখন। ফলে নদীর পাড় ভাঙ্গা-গড়ার খেলা অব্যাহত রয়েছে। তবে সস্প্রতি কীর্তনখোলায় শঙ্কা বাড়াচ্ছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য। নদীর পানি দূষিত হওয়াসহ গতিধারায় প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা থেকে পরিত্রাণ পেতে এখনই সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।
জানা গেছে, মোট ৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কীর্তনখোলা নদীর বৃহৎ একটি অংশ বরিশাল শহর ঘেঁষে রয়েছে। শহরের গোটা ড্রেনেজ ব্যবস্থার বর্জ্যযুক্ত পানি নগরের বিভিন্ন খাল হয়ে কীর্তনখোলা নদীতে যাচ্ছে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম নদীবন্দর বরিশালে অবস্থিত। যে নদীবন্দর দিয়ে অভ্যন্তরীন ও দূরপাল্লার রুটে প্রতিদিন ছোট-বড় অর্ধশতাধিক যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে। এসব লঞ্চের বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাও সরসরি নদীতে হওয়ায় ধীরে ধীরে দূষিত হচ্ছে কীর্তনখোলার পানি। বরিশাল নদীবন্দর এলাকা ঘিরে বিপুল সংখ্যক মানুষের আনোগোনা ও ভাসমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পল্টুন সংলগ্ন এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যাত্রীরা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত পলিথিন ও প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন সামগ্রী লঞ্চে কিংবা পল্টুনে বসেই সরাসরি নদীতে ফেলছে। এমনকি লঞ্চগুলোকে পরিস্কারের নামে এর স্টাফরাও সরাসরি নদীতে ময়লা-আবর্জনা ঝাড়- দিয়ে ফেলছে। ফলে সেসব ময়লা আবর্জনা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে এবং নদীবন্দর সংলগ্ন এলাকায় আলাদা একটি স্তর তৈরি করছে।
সস্প্রতি সময়ে বরিশাল নদীবন্দর সংলগ্ন এলাকায় নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে চলমান ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে এমন তথ্যই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, পলিথিনসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রীর কারণে খনন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তবে এর থেকেও অদূর ভবিষ্যতে প্রাণীকূলসহ বড় সমস্যায় পড়ার শঙ্কা রয়েছে কীর্তনখোলা।
বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, একটি ড্রেজিং মেশিন দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা খনন কার্যক্রম চালাতে সক্ষম। বরিশাল নদীবন্দর এলাকাতে সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা ৫০ মিনিট এক নাগারে ড্রেজিং করেছি। কিন্তু সস্প্রতি নদীবন্দরে অহেতুক লঞ্চগুলোকে নোঙর করে রাখা এবং ড্রেজিং মেশিনের কাটারের সাথে বার বার পলিথিনসহ প্লাস্টিক সামগ্রী আটকে যাওয়ায় ৫-৬ ঘণ্টার বেশি খনন কাজ চালানো সম্ভব হয়না।
তিনি আরও বলেন, নদীবন্দরের পল্টুন সংলগ্ন এলাকায় খনন করতে গিয়ে বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে যে প্রতি আধঘণ্টা পরপর কাটার ব্লেড পরিস্কার করতে হয় এবং একবার পরিস্কার করতে ২০-২৫ মিনিট সময় লেগে যায়। ফলে খনন কাজে ধীরগতি চলে এসেছে। তাই যে কাজ দুই মাসের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হতো, তা শেষ করতে এখন অনেক বেশি সময় লাগছে। তিনি বলেন, পলিথিনের পরিমাণ অনেক বেশি। আমরা ড্রেজিং মেশিনের কাটার ব্লেড পরিস্কার করে যে পলিথিন পাই, তাতে কোনো কোনো দিন ৩-৪ বার ট্রলার ভর্তি হয়ে যায়।
স্থানীয় একাধিক ট্রলার মাঝিরা বলেন, প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় লঞ্চগুলো পরিস্কারের নামে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা নদীর বুকে ফেলা হচ্ছে। যা কেউ নিষেধও করছে না। শীতের সময় নদীবন্দর ও আশপাশের এলাকায় পানি কমে গেলে দেখা যায় কীভাবে মাটিতে পলিথিন আটকে রয়েছে। আর তাতে পানি ও ময়লা আটকে পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করার আগেই এখনই দূষনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তাতে যেমন নদী বাঁচবে, তেমনি প্রাণীকূল ও মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
বরিশাল নদীবন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু সরকার বলেন, আমরা ইতোপূর্বে সব লঞ্চ কোম্পানিকে নদীতে ময়লা-আবর্জনা না ফেলার জন্য চিঠি দিয়েছি। তাদের যেমন বিন ব্যবহার করতে বলেছি, তেমনি নদীবন্দরের সাথে দক্ষিণ দিকে একটি ডাস্টবিনও করেছি, যেখান থেকে সিটি কর্পোরেশন ময়লা নিয়ে যায়। তবে এখন পর্যন্ত গ্রীনলাইনসহ হাতে গোনা কয়েকটি লঞ্চ তাদের যাত্রীদের সৃষ্ট বর্জ্য নির্দিষ্টস্থানে রাখার ব্যবস্থা করেছে। তিনি বলেন, সবারই উচিত নদী পরিস্কার রাখা। এখন যে ড্রেজিং কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে, তাতে কিন্তু ভোগান্তি শুধু আমাদের নয়, লঞ্চ মালিক ও শ্রমিকদেরও হচ্ছে। একাধিকবার বলার পরেও যারা বর্জ্য নদীতে ফেলছেন তাদের বিরুদ্ধে খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের বন্দর এলাকাতে ডাস্টবিন বসানো রয়েছে। ভবিষ্যতে পল্টুনেও বিন বসানো হবে, তবে তার আগে সাধারণ মানুষদের সচেতন হতে হবে। আমরা যেন সবাই ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্টস্থানে ফেলতে অভ্যস্ত হই। তাহলে আমাদের আশপাশ যেমন পরিস্কার থাকবে, তেমনি নদীসহ গোটা পরিবেশ দূষনমুক্ত থাকবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক আবদুল হালিম বলেন, নদীতে পলিথিন, প্লাষ্টিকসহ ময়লা-আবর্জনা না ফেলার জন্য লঞ্চ কোম্পানিগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেকেই তা মানছেন না। তাই তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। তিনি আরও বলেন, সবার আগে সচেতনতা প্রয়োজন। ময়লা-আবর্জনার কারণে এই নদী দূষিত হলে ভোগান্তিটা কিন্তু আমাদেরই বেশি হবে। আমরা চাই মানুষ নিজ থেকে ময়লা-আবর্জনা নদীতে না ফেলুক। আর সে লক্ষ্যে আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনাও অব্যাহত রেখেছি।