বেঁচে থাকতে যদি অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরতে হয়, তাহলে মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে কি হবে। তাই পরিবারের সকলের কাছে বলেছি, মৃত্যুর পর আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া না হয়। যে দেশে মন্ত্রীর নির্দেশও উপেক্ষা করা হচ্ছে। এই দেশের জন্যই কি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেদিন জীবন বাঁজি রেখে যুদ্ধ করে বিজয় পতাকা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। তা ভেবে অনেকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আক্ষেপ করে আবেগ আপ্লুত কন্ঠে জনকণ্ঠর এ প্রতিনিধির কাছে কথাগুলো বলছিলেন, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থাকা শষ্যাশয়ী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল খান।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের সাকোকাঠী গ্রামের মৃত গঞ্জর আলী খানের পুত্র ইসমাইল খান। বর্তমানে নানারোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসাসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র পুত্র জামাল খান রাজমিস্ত্রির সহযোগি হিসেবে কাজ তরে কোন একমতে সাত সদস্যর পরিবারের ভরন পোষন করছেন, যেমন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ইতোমধ্যে এ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করাতে গিয়ে তার পরিবারের একমাত্র সম্ভল বসত ভিটে বিক্রি করে তারা আরও নিঃস্ব হয়ে পরেছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার উন্নত চিকিৎসা করাতে আরও প্রায় পাঁচ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু এ টাকা যোগার করা তার অসহায় পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পরেছেন।
সম্মুখ যুদ্ধে গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আঘাত নিয়ে শষ্যাশয়ী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সেইদিনের পাকবাহিনীর দোসররা আজও এ দেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটাই বড় কস্ট। আর ওইসব দোসরদের কারণেই আমার জীবনটা আজ বিপন্ন। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ইসমাইল খান বলেন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদিয়ে ১৯৭১ সালের পহেলা এপ্রিল আমি একই গ্রামের তৎকালীন সেনা সদস্য আবদুল আজিজ হাওলাদারের উৎসাহে স্থানীয় ওহাব খান ও আবদুল হালিম খানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ তৈরি করি। আমাদের গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ছিলো প্রায় তিনশ’। দেশমাতৃকার টানে পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে আমিসহ গ্রুপের সদস্যরা প্রশিক্ষণের জন্য একাধিক নৌকাযোগে নদী পথে ধামুড়া হয়ে সাতক্ষীরা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। সেখানকার (ভারত) টার্কি ক্যাম্প ও বীরভূমে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পর ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিল ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক (বঙ্গবন্ধুর বোন জামাতা) আবদুর রব সেরনিয়াবাত যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে আউয়াল হাবিলদারকে দায়িত্ব দিয়ে আমাদের ৬০জনের একটি মুক্তিবাহিনীর দলকে সাতক্ষীরার বসন্তপুর দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়। আমরা দেশে প্রবেশ করার পর পরই বসন্তপুর এলাকায় বসে পাকসেনাদের সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আমরা খুলনার বড়কুলিয়া, সাতক্ষীরা, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর এলাকায় পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ করি।
সর্বশেষ নভেম্বর মাসের শেষেরদিকে দেবাটা এলাকায় পাক সেনাদের সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। ওই যুদ্ধে আমাদের অসংখ্য সহযোদ্ধা শহীদ হন। একপর্যায়ে পাকিদের ছোঁড়া গ্রেনেডের অসংখ্য ¯প্রীন্টারের আঘাতে আমি গুরুতর আহত হয়ে পাশ্ববর্তী একটি বাথরুমের ট্যাঙ্কির মধ্যে পরে যাই। যুদ্ধ শেষে মুমূর্ষ অবস্থায় আমাকে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আউয়াল হাবিলদার ও সহযোদ্ধা কবির হোসেন খান উদ্ধার করে ভারতের হাসনাবাদ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়ে আমি কিছুটা সুস্থ্য হয়ে পূর্ণরায় দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। গ্রেনেডের ক্ষতবিক্ষত আঘাতের পর সেইদিন যে প্রাণে বেঁচে যাব তা কখনো ভাবিনি। সেদিনের কথা মনে হলে আজো গাঁ শিউরে ওঠে।
দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধাহত জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ভূমিহীন মোঃ ইসমাইল খানের (৭০) নাম সরকারের মুক্তিবার্তা নং (লাল বই)-০৬০১১০০২৫৪, যুদ্ধাহত গেজেট নং-১৫০১, মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নং-৩৪২৩, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং-১৩৫২৫ অর্ন্তভূক্ত হয়ে শুরু থেকেই তিনি (ইসমাইল খান) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি ভাতা পেয়ে সাত সদস্যর পরিবার নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রনে তিনি অসংখ্যবার জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণও করেছেন।
ভূমিহীন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান বলেন, মনের টানে আমি প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর ছবি অঙ্কিত গেঞ্জি ও টুপি পরতাম। ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে স্থানীয় সাকোকাঠী মিশুকস্টান্ডে বসে বঙ্গবন্ধুর ছবি অঙ্কিত গেঞ্জি ও টুপি পরিহিত অবস্থায় আমাকে দেখে অশ্লীলভাষায় গালিগালাজ করে শাহাজিরা গ্রামের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মোজাম্মেল খান ও তার সহযোগি অপর বিএনপি নেতা শাহজাহান হাওলাদার। একপর্যায়ে তারা আমাকে বিএনপিতে যোগদানের জন্য চাঁপ সৃষ্টি করায় তাদের সাথে তুমুল বাগ্বিতন্ডা হয়। এরজেরধরে ওই প্রভাবশালী বিএনপি নেতারা আমাকে (যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানকে) মারধর করে বঙ্গবন্ধুর ছবি অঙ্কিত গেঞ্জি টেনে ছিড়ে ফেলে। বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পাকিদের দোসর বিএনপি ও জামায়াত ঘরোয়া মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে আমাকে ভূয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টসহ বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে অদ্যবর্ধি আমার (ইসমাইল খান) ভাতা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ কারণেই পরিবার পরিজন নিয়ে নানারোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থাকা ইসমাইল খান এখন চরম অর্থকষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
ইসমাইল খান বলেন, আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যে অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দপ্তর থেকে আমাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, যুদ্ধকালীন জীবিত কমান্ডার, সহযোদ্ধা ও স্বাক্ষীদের নিয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রতিটি দপ্তরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, যুদ্ধকালীন কমান্ডার, সহযোদ্ধা ও স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করার পর আমার পক্ষে রায় দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের পরিচালকের সাথে সাক্ষাত করার পর তিনি আমার সকল কাগজপত্র পর্যালোচনাসহ যুদ্ধকালীন কমান্ডার, সহযোদ্ধা ও স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করে আমার পক্ষে রায় দিয়ে বলেন, সাময়িকভাবে বন্ধ ভাতা খুব শীঘ্রই চালু করা হবে। পরবর্তীতে দীর্ঘদিনেও ভাতা চালু না হওয়ায় আমি (ইসমাইল খান) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি’র বরাবরে ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা চালুর দাবিতে’ আবেদন করে সরাসরি দুইবার তার (মন্ত্রী) সাথে সাক্ষাত করি। দুইবারই মন্ত্রী আমার আবেদনের যাচাই করে জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করেন। মন্ত্রীর নির্দেশের পরেও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট থেকে আমার বন্ধ ভাতা আজো চালু করা হয়নি। এরইমধ্যে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য অভিযোগকারীদের পক্ষ থেকে স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি আমার (ইসমাইল খান) কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদাও দাবি করে।
অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান উপায়অন্তুর না পেয়ে তার বন্ধ ভাতা চালু করার দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের একমাত্র শক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি সাক্ষাত করার জন্য গতবছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গিয়েছিলেন। ওইসময় রাষ্ট্রীয় কাজে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় ইসমাইল খান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডাক গ্রহণ ও বিতরণ শাখায় প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে লেখা একটি আবেদন জমা দিয়ে আসেন। দীর্ঘদিনেও ওই আবেদনের সারা না পেয়ে ওই বছরের ২৫ অক্টোবর তিনি (ইসমাইল খান) ডাকযোগে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে খোলা চিঠি প্রেরণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণ কাঁপানো শষ্যাশয়ী অসহায় যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান তার সাময়িকভাবে বন্ধ ভাতা চালু করাসহ সু-চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।